আমি তো অবাক। একটা টিকটিকির ল্যাজ কাউকে কখনো দেয় না, ও দেবে আমাকে একগাদা চুইংগাম। তবেই হয়েছে!
এমনি করে কত মাইল যে চলে এসেছি তার ঠিক নেই। বেশ বেলা বেড়েছে এমন সময় দূর থেকে দেখি রাস্তা যেখানে রেলের লাইন পার হয়েছে, সেখানে বিরাট তেঁতুলগাছের তলায় মেলা লোকের ভিড়।
বেশ খানিকটা দূরেই আছি, কিন্তু শ্যামাদাসকাকা দেখলাম খুব ঘাবড়েছে। স্টিয়ারিংটাকে কষে চেপে ধরেছে, হাতের গিঁটগুলো সব সাদা সাদা হয়ে উঠেছে। চুলগুলোও খাড়া খাড়া, সারা কপাল জুড়ে এই বড়ো বড়ো ঘামের ফোঁটা।
সত্যি বিষম ভিড়। আর এক বার অবাক হয়ে যেই শ্যামাদাসকাকার দিকে তাকিয়েছি, সে কর্কশ গলায় বলল, কিছু করবার না থাকে তো আমার দিকে না তাকিয়ে বুড়ো আঙুল চোষো।
ততক্ষণে শ্যামাদাসকাকার কপালের পুরোনো ঘামগুলো গলে গিয়ে নদী হয়ে, ওর জামার গলা দিয়ে নামতে লেগেছে আর তার জায়গায় নতুন সব ঘামের ফোঁটা দেখা দিয়েছে।
ভিড়ের কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম। দেখি একটা চা-ওলা তার ছোট্ট তোলা উনুন, চোঙা-দেওয়া পেতলের চা-দানি আর টুকরি করে মাটির ভাঁড় নিয়ে, একেবারে কাছ ঘেঁষে বসে আছে। কিন্তু শ্যামাদাসকাকা যেন দেখতেই পাচ্ছে না।
মুণ্ডু ঘুরিয়ে পেছনের সিটের দিকে চেয়ে দেখলাম। ঠানদিদি আর বিরিঞ্চিদাও চোখ গোল গোল করে এ-ওর দিকে চেয়ে আছেন, গালের রং ফ্যাকাশে, মুখে কথাটি নেই। কী জানি বাবা!
ভিড়ের জন্য গাড়ি থামাতে হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করছিলাম যারা ট্রেনে কাটা পড়েছে তাদের মাথাগুলো একেবারে আলাদা হয়ে গেছে কি না।
কিন্তু কিছু দেখা গেল না, মড়া না, কিছু না। চা-ওলার কাছে দেখলাম কাচের বাক্সে বাঁদর বিস্কুট। কী ভালো খেতে বাঁদর-বিস্কুট, শক্ত, সোঁদা গন্ধ, চমৎকার! কিন্তু পয়সাকড়ি নেই।
এদিকে এরা সব যেন ভয়ে কাঠ।
ভিড়ের মধ্যে চেয়ে দেখি ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে রয়েছে সন্দেহজনক কত যে লোক তার ঠিক নেই। সেইসঙ্গে লাঠি হাতে নীল পাগড়ি কত পুলিশ! কিছু একটা যে ঘটেছে সেটা ঠিক।
ডেকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, এই পাহারাওয়ালা, কুছ হুয়া? কিন্তু জিজ্ঞেস করব কি, মুখ হাঁ করতেই বিরিঞ্চিদা আর ঠানদি ফিরে আমার মুখ চেপে ধরলেন! আর শ্যামাদাসকাকা পর্যন্ত আমার দিকে ফিরে বললে, ইডিয়ট!
সামনেই একটা রোগা লোক দাঁড়িয়েছিল, গায়ে গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, চুল কোঁকড়া তেল-চুকচুকে।
সে আমাদের গাড়ির পাদানির ওপর চড়ে পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসতে লাগল। দেখলাম ওর কানে সোনার মাকড়ি পরা আর একটু করে চুন লাগানো। তাহলে নাকি পান খেলেও মুখ পোড়ে না। একদিন দেখতে হবে।
লোকটা নিজের থেকে বললে, এখানকার জমিদারবাবুর স্ত্রীর মুক্তোর মালা হারিয়েছে। তাই ধরপাকড় চলছে।
আমাদের গাড়ির লোকরা এতক্ষণ কাঠপুতুলের মতো সামনের দিকে চেয়ে বসেছিল, এবার তিন জনে একসঙ্গে বিষম একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, ওই লোকটার সঙ্গে মেলা গল্প জুড়ে দিল।
ওইখানে লেভেল ক্রসিং-এর ধারে, ভিড়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, শ্যামাদাসকাকা ও বিরিঞ্চিদা আর ঠানদিদি সেই লুঙ্গিপরা মাকড়িকানে অচেনা লোকটাকে কী যে না বলল তার ঠিক নেই।
অবাক হয়ে সব শুনলাম, আগে এসব কিছুই জানতাম না।
বলল আমরা নাকি মোটরে গয়া যাচ্ছি ঠানদিদির বাবার পিণ্ডি দিতে। অথচ ঠানদিদির যে আবার বাবা আছে এ তো কখনো শুনিনি। নিজেই উনি যথেষ্ট বুড়ো।
ঠানদিদি নাকি পিণ্ডি দেবেন, বিরিঞ্চিদা জোগাড় দেবে, শ্যামাদাসকাকা গাড়ি চালাবে। আর আমি হলাম ঠানদিদির নাতি, নাকি কেঁদে-কেটে সঙ্গ নিয়েছি, ঠানদিদিকে ছেড়ে একদণ্ড থাকতে পারি না।
এই বলে ঠানদিদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুল নোংরা করে দিলেন। আমি এমনি অবাক হয়ে গেছলাম যে কিছু বললাম না। শুধু পকেট থেকে আয়না-চিরুনি বের করে, চুলটাকে যত্ন করে ফের আঁচড়ে নিলাম। আশা করি এতেই ওঁকে যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া হল।
ঠিক সেই সময় সাদা পেন্টেলুনপরা কালো ইন্সপেক্টরবাবু ভিড় ঠেলে এসে হাজির। আর অমনি লুঙ্গিপরা লোকটা টুপ করে নেমে হাওয়া।
শ্যামাদাসকাকাও ঘন ঘন হর্ন দিতে লাগল, ঠানদিদি আর বিরিঞ্চিদা ইদিক-উদিক গাছপালা দেখতে লাগলেন, যেন কিছুই জানেন না।
ইন্সপেক্টরবাবুকে শ্যামাদাসকাকা সিগারেট খাওয়াল, আর সে বললে, ও-কে।
অমনি ভিড়টা দু-ভাগ হয়ে গেল আর আমরা রেলের লাইন পার হয়ে, ওপারের পথ ধরলাম।
আর থাকতে পারলাম না। স্টিয়ারিঙের ওপর শ্যামাদাসকাকার হাতটা চেপে ধরে বললাম, বলতেই হবে কেন পালাচ্ছ তোমরা।
ওর হাতটা অমনি স্টিয়ারিং থেকে খসে গেল আর গাড়িটাও ল্যাগব্যাগ করে উঠল। শ্যামাদাসকাকা তো হাঁ।
পেছন থেকে ঠানদিদি গম্ভীর গলায় বললেন, পেছনে হুলিয়া লেগেছে, না পালিয়ে উপায় নেই।
০২. হুলিয়া লেগেছে
হুলিয়া লেগেছে। ইস্। শ্যামাদাসকাকার কাছে আরেকটু ঘেঁষে বসলাম। সে বললে, উঁ! উঁ! গিয়ার চিপকিয়ো না।
বিরিঞ্চিদা বললে, আমরা ফেরারি, ঘরবাড়ি ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছি। হল এবার? ভোর-ইস্তক খালি বলে– কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। কেমন, এবার খুশি তো?
ঠানদিদি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না চিরদিনের জন্য নয় মোটেই। ডিসেম্বর মাসে ওর পরীক্ষা-না? তা ছাড়া মশলার কৌটো তো ফেলে এসেছি। তারজন্যও এক বার ফেরা দরকার।