এমনি সময় দাড়িওয়ালা ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই ইন্সপেক্টরবাবু মনিব্যাগ বের করলেন, ক-মাসের মাইনে দেয়নি?
বুড়ো তো আহ্লাদে আটখানা।
–ছ-টি মাস দেয়নি স্যার। সম্পর্কে দাদা হই, সব কাজ করিয়ে নেয়, নিজেদের গোরুকে নিজেরা ভয় পায়। ছ-মাস মাইনে দেয়নি, ছ-যোলং চৌষট্টি।
ইন্সপেক্টরবাবু ওর হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, আপাতত এইটে নাও তো। আচ্ছা এসব জিনিস চুরি করে আনে কারা? চালানই-বা করে কারা?
বুড়ো খুশি হয়ে বললে, সে আমাদের লোক আছে স্যার, নিজের হাতে সব ট্রেনিং দিয়েছি। কম-সেকম পনেরো-কুড়িজন ভাড়া খাটে। সবচেয়ে চালাক কে জানেন?–ওই ঝাঁকড়াচুল– উমমা–
বুড়ি আর রোগা বেচারা ওর মুখ চেপে ধরে বলল, না দেখুন ভীষণ মিথ্যেবাদী, দেখুন।
ইন্সপেক্টর সব কথা খাতায় টুকে নিয়ে বললেন, ব্যস্, মালার ব্যাপার ছাড়া আর সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কিছু ভাববেন না আপনারা, ফঁসি বন্ধ করে দেব। চাই কী এক-আধজনকে জেলে না-ও দিতে পারি। কিন্তু মালাটাই যে ভাবিয়ে দিলে মশাই। ওটি না পেলে কি মাইনে বাড়বে? দেখুন জমিদারবাবু, এতক্ষণ কিচ্ছু বলিনি এবার কিন্তু রেগে গেছি। আপনি নাহয় বড়োলোক কিন্তু তাই বলে আমার উন্নতি বন্ধ করে দিতে পারবেন তা ভাববেন না। ঠিক বলছেন এটা আপনার মালা নয়?
জমিদারবাবু মাথা নাড়লেন। ইন্সপেক্টরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, নয় কেন বলুন? এটা কীসে মন্দ?
জমিদারবাবু মহা ফাঁপরে পড়ে গেলেন, ইয়ে মানে এটা আমার গিন্নি পরতেন না– ওই ঝাকড়াচুল– এইটুকু বলেই জমিদারবাবু থামলেন।
–আহা থামলেন কেন? ওই ঝাঁকড়াচুল কি?
জমিদারবাবু কিছু বলবার আগে সে ছোকরাই এগিয়ে এসে বলল, আমি বলব স্যার?
জমিদারবাবু ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গিয়ে বললেন, আরে চুপ চুপ, দেব রে এক-শো টাকা নিশ্চয় দেব। এ তো দেখি আচ্ছা গেরো।
ইন্সপেক্টর বললেন, দেখুন বাজে কথা রেখে আগাগোড়া খুলে বলুন।
জমিদারবাবু কোঁচা দিয়ে মুখ মুছলেন।
–একটুও বাদ দিতে পাব না?
–না, সব শুনব।
–কিন্তু কিন্তু গিন্নি যে রেগেমেগে পুলিশের সম্বন্ধে
–আচ্ছা আচ্ছা সেইটুকু নাহয় ছেড়েই দিলেন।
জমিদারবাবু তখন একটা নীচু দেখে বাক্সের ওপর বসে পড়ে বললেন, বেশ তবে সব কথাই শুনুন। আমাদের সাতপুরুষের জিনিস ওই মালা। লাখ টাকা ওর দাম। লাখ টাকা দিয়ে ইনসিওর করা। হারালে লাখ টাকা পাওয়া যায়। গিন্নি প্রাণ দিয়ে সেটি আগলান। সারাদিন গলায় ঝোলে, সারারাত বালিশের নীচে থাকে। সেই মালা বালিশের তলা থেকে উধাও। কেউ কোথাও নেই, ঘর ভেতর থেকে বন্ধ, শুধু বালিশের নীচে মালাগাছি নেই।
তাই নিয়ে গিন্নি যে অতটা রসাতল করবেন এ আমার ভাবনার বাইরে ছিল মশাই। আর ইসিওরেন্স কোম্পানিকে বছরে বছরে টাকা গুনে দেওয়া হয়েছে, তাদের বাঙালি সায়েবেরও যে কী সন্দেহবাতিক সে আর কী বলব! কেমন করে গেল, কোথা দিয়ে গেল, বললেই হল কিনা চুরি, দেব না টাকা, আগে প্রমাণ করুন সত্যি চুরি গেছে। এইরকম। তখন কী আর করা যায়, এই ছোকরার পায়ের ছাপটা দেখাতে হল!
শুনে সবাই অবাক, ওমা সে কী? ছোকরার পায়ের ছাপ আবার কী?
জমিদারবাবু তখন অপ্রস্তুত মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি সবটা বলতে হবে, গিন্নি শুনলে–
–আহা কী জ্বালা, বলুন বলুন, গিন্নিকে আবার কে বলতে যাচ্ছে?
–তবে শুনুন। ইয়ে মানে ছোকরাকে বললাম তোকে কিছু করতে হবে না, জানলার বাইরে দাঁড়াবি আমি গরাদের ফঁক দিয়ে গলিয়ে দেব, তুই উধাও হবি। পরে রেলের ক্রসিং-এ আমার হাতে দিয়ে দিবি। তাহলে তোকে এক-শো টাকা দেব। তোর কোনো বিপদ নেই। বলুন মশাই, ছিল ওর কোনো বিপদ যে এখন ও-রকম তেড়িয়া হয়ে থাকবে?
না, না, সে তো বটেই।
–সে তো বটেই আবার কী? ব্যাটা মালা নিয়ে বেমালুম উধাও। রেলের ধারে তার দেখা নেই। এদিকে গিন্নির জ্বালায় আমি যেখানে যাই পুলিশও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দেয়। সেই থেকে আপনারা যে আমার পেছনে ছিনেজেকের মতো একনাগাড়ে লেগে রয়েছেন মশাই। দে রে বাপ মালাটি, ইসিওরের টাকায় আমার কাজ নেই, মালাটা এখন গিন্নিকে ফিরিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
ছোকরা অমনি শ্যামাদাসকাকাকে দেখিয়ে দিলে।
আপনার কথায় বিশ্বাস করেই মালা নিয়ে সরে পড়েছিলাম, আপনারাই যে পেছনে পুলিশ লাগাবেন তা কি আর ভেবেছিলাম। রেলের ধারে গিয়ে দেখি ধরপাকড় চলছে, তখন বেগতিক বুঝে ওই ভদ্রলোকের পকেটে মালা চালান করে দিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমি নাকে কানে খত দিয়েছি সোনাদানা আর ছোঁব না। ইস্কুলে ভরতি হব। যদি মন্টু-পটলাদের ক্লাসে নেয় অবিশ্যি।
তাই শুনে বুড়ি আর বেচারা ভদ্রলোক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওকে সে কত আদর! ওই বুড়োধাড়ি ছেলেকে, ভাবো এক বার!
১৩. এদিকে সবাই তো
এদিকে সবাই তো শ্যামাদাসকাকার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তখন দুই পকেট উলটে দিয়ে, দুই হাত শূন্যে তুলে বললে, প্রমিস্, আমার কাছে নেই। দেখতে পারেন ঝেড়ে ঝুড়ে। মালা কোন কালে ওই গুপে লক্ষ্মীছাড়াকে দিয়ে দিয়েছি। কী দরকার রে বাবা পরের জিনিসে, বিশেষ করে যখন তার মধ্যে এত বিপদ! গুপে, মালা দিয়ে দে, ভালো চাস তো।
আমিও তখুনি শার্ট খুলে ফেলে দিয়ে, প্যান্টেলুন ঝেড়েঝুড়ে সবার সামনে দেখিয়ে দিলাম যে আমার কাছে মালাটালা তো নেই-ই, অনেকগুলো বোতামও নেই।