তাই শুনে বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই এমনি অদ্ভুত চেঁচিয়ে উঠলেন, ও কাজও করবেন না মশাই, ওর কচিপানা মুখ দেখে বিচারবুদ্ধি হারাবেন না। ওই হল গিয়ে পালের গোদা, মশাই, ওই হল সর্দার।
সেজোদাদামশাই কী বিরক্ত!
–আরে রাখো! তোমাদের বিরিঞ্চিটিও কম পাজি নয়।
ইন্সপেক্টরবাবু হকচকিয়ে গেলেন মনে হল, এক বার এর মুখ দেখেন, এক বার ওর মুখ। শেষটা আমি নিজেই এগিয়ে এসে বললাম, আমার নাম গুপি চক্রবর্তী, বয়স এগারো, ক্লাস সেভেনে পড়ি, মাথায় সাড়ে চার ফুট, ওজন–
ইন্সপেক্টরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, থামো ছোকরা! বড় বেশি কথা বল!
দেখলে তো মজা? আবার ঠানদিদিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম আর ঠিকানা?
ঠানদিদি মাথায় কাপড় আরো টেনে দিয়ে ইন্সপেক্টরবাবুর দিকে পিঠ ফিরিয়ে বললেন, ও মাগো!
সেজোদাদামশাই বললেন, লিখুন, নিস্তারিণী দেবী। ৪৩, হরিশংকর লেন, কলিকাতা।
ইন্সপেক্টর এ-সবই খাতায় টুকে বললেন, এখানে আসার অভিপ্রায়–?
বিরিঞ্চিদা ঝুঁকে পড়ে বললে, গয়ার কথাটা বলবে।
সেই খোশামুদে লোকটা বললে, উঁহু! সাক্ষীকে হামলা করবেন না।
ঠানদিদি ভারি খুশি হয়ে বললেন, গয়ায় যাচ্ছিলুম, পথ হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি, তাতে দোষটা কী হয়েছে গা?
ইন্সপেক্টরবাবু তাই টুকতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় সেজোদাদামশাই ছুটে এসে রেগেমেগে বললেন, কী মিছে কথা! পাছে আমার গুরুদেবকে–এদের সামনে তার নাম করাও পাপ পাছে তাঁর চরণে আমার মার গয়নাগাটিগুলো দিয়ে ফেলি, তাই তুমি সেসব নিয়ে সরে পড়নি বলতে চাও, বউঠান? ওই গয়নার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার, বাকি আমার আর ইয়ে গুপির বাবার। ওদিকে গুরুদেব সোনার গাড়র অভাবে কী কষ্টই-না পাচ্ছেন?
ইন্সপেক্টর খচখচ লিখতে লিখতে, একবার থেমে সেজোদাদামশাইয়ের জামা ধরে টেনে জিজ্ঞেস করলেন, গুরুদেব কার সোনার গাড় নিয়েছেন না কী যেন বললেন, ভালো করে শুনতে পেলাম না। আরেক বার কথাগুলি বলবেন স্যার?
শুনে তো আমার দারুণ হাসি পেল। সেজোদাদামশাই কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। ইন্সপেক্টর একটু অপেক্ষা করে বুড়িকে বললেন, আপনার নাম ও পেশা?
বুড়ি বললেন, আমার নাম স্বভাবসুন্দরী দাসী। আর পেশার কথা আমি কিছু বলতে পারব, সে আমার অনেক উপকার করেছে।
খোশামুদে লোকটি বললে, কী আপদ। পেশার কথা কে শুনতে চায়? আপনার কী করা হয়। তাই বলুন।
–আর কী করা হবে? রান্না করা হয়। আমার খোকা কিন্তু জমিদারবাবুকে চেনে না।
খোকা বুড়ির হাত ছাড়িয়ে হাঁড়িমুখ করে বললে, এতদিন চিনিনি, এবার খুব চেনা গেছে। দিন, মশাই, আমার একশো টাকা।
জমিদারবাবু তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, আহা, থামো থামো, বলেছি তো দেব।
ইন্সপেক্টরবাবু হতাশ হয়ে পাশের লোকটিকে বললেন, আমি তো কিছু বুঝে উঠলাম না, শম্ভ, তুমি একটু দেখো তো।
শম্ভু তখন তড়বড় করে এগিয়ে এসে বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকাকে লাইন থেকে টেনে বের করে এনে, ধমক দিয়ে বলল, আপনারাই যে রিংলিডার সেকথা অস্বীকার করে কোনো ফল হবে না মশাই, আপনাদের কপালে লেখা রয়েছে বদমায়েশ, ধড়িবাজ। বিলেতে ওই যেসব চোরাকারবার ধরা পড়েছে, তার গোড়াতেও যদি আপনারা থাকেন তো কিছুই আশ্চর্য হব না। নিন, এখন ভালো চান তো বলে ফেলুন আগাগোড়া সব ব্যাপারটা।
তখন বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা ঢোক গিলে, জিব কামড়ে, আমতা আমতা করে, এক জন থেমে, এক জন জোরে, আমাদের কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার পর থেকে সব কথা মোটামুটি বলল।
শুনে ইন্সপেক্টরবাবু বললেন, বটে।
তারপর বিরিঞ্চিার পিসেমশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, কী যেন বলছিলেন আপনি?
পিসেমশাই বললেন, কী আর বলব মশাই, আমার বন্ধু ঘেঁটুর মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে-টিয়ে ঠিক। টোপর কেনা, পুরুতঠাকুরকে বায়না, বরপণের টাকা হাফ ও নেবে আর হাফ আমি নেব সব ঠিক, আর মাঝখান থেকে একেবারে ভাগলুয়া। বল, হতভাগা পালালি কেন?
বিরিঞ্চিদা মুখ লাল করে বললে, শ্যামাদাস যে বললে, ওই মেয়ে ভীষণ রাগী, নাকি চটে গেলে নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়?
–কী? শ্যামাদাস বললে। বাঃ, চমৎকার কথা, শ্যামাদাস বললে। আর শ্যামাদাস কী করেছে। তা জানিস? নিজের মামাকে বেদম পিটে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কেন তা জানিস? কারণ মামা বলেছিল, বলাই চাটুয্যেই-বা কী, আর গোষ্ঠ পালই-বা কী, ছিল শুধু একজন– ব্যস্ ওই পর্যন্ত তার নামটুকুও বলবার আগেই মামাকে একেবারে ফ্ল্যাট, একেবারে মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে এত বড়ো পাজি। কৈমন ঠ্যাঙাড়ে সব সঙ্গী জুটিয়েছ, এবার বুঝতে পারছ আশা করি?
বুড়ি এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিল, এবার বললে, ওমা। কোথায় যাব গো। একটা চোর, একটা ফেরারি, একটা খুনে। ওই ছোকরাটার কথা তো জিজ্ঞেস করতেও ভয়ে হাত-পা পেটে সেঁদোচ্ছে। এই চার-চারটে লোক আমাদের বাড়িতে রাত কাটাল তবু যে বেঁচে আছি তাই রক্ষে।
ইন্সপেক্টরবাবু একটু হাসলেন।
–যা বলেছেন মা-ঠাকরুন। এবার আসুন, এইসব চোরাইমালের গাদার একটা হিসেব দিন। বুড়ি যেন আকাশ থেকে পড়ল।
-ওমা বলে কী। আমার বিয়ের যৌতুক বাবা কত কষ্ট করে দিয়েছিল পঁচিশ বছর ধরে আগলেছিনা। যাতে উই না ধরে, যাতে ডাকাতে না নেয়, তাকে বলে কিনা চোরাইমাল।
বলে একটা ভাঙা হারমোনিয়ামের পিঠে হাত বুলোত লাগল।