কিন্তু কে শোনে। সবাই একদৃষ্টে মাচার পানে তাকিয়ে, কারণ মাচাবাঁধা পুরোনো দড়ি, চোখের সামেন আস্তে আস্তে ছিঁড়ে দু-টুকরো হয়ে গেল, একরাশি বিছানা-বালিশ ঝুপঝাঁপ নীচে পড়ল, তার সঙ্গে একপাটি লাল বিদ্যাসাগরি চটিও পড়ল।
আশ্চর্য হয়ে ওপর দিকে চেয়ে দেখি যে কঁকড়াচুল ছোকরা, কানে মাকড়ি ও এক পায়ে চটি পরে মাচার বাঁশ ধরে ঝুলছে। আস্তে আস্তে বাঁশটিও খুলে এল আর সেও নেমে পড়ল।
নেমেই জমিদারবাবুকে বলল, এই তো দেখা হল, তাহলে দিন দশ টাকা।
আমরা সবাই তো হাঁ!
তারপর বুড়ি চাপা গলায় বললে, এই খোকা, পালিয়ে যা বলছি। এখানে থাকলে তোকে এরা বিপদে ফেলবে। ভালো চাস তো পালা।
খোকার কিন্তু সেদিকে কানই নেই। জমিদারবাবুকে আবার বলল, কই, বের করুন টাকা। এই তো আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলাম।
ঠানদিদির এতক্ষণ কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবার বুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে? ওই যে কানে মাকড়ি?
বুড়ি তেড়িয়া হয়ে উঠল, উটি আমার ছেলে আর ওই রোগা মানুষটি আমার স্বামী। কেন, আপনার কোনো আপত্তি আছে? না কি আর কিছু জিজ্ঞেস করবার আছে?
ঠানদিদি বললেন, তা বাছা, আছে বই কী। তোমাদের এখানে ব্যাপারখানা কী বলো তো? রাত্তিরে লণ্ঠন নিয়ে আনাগোনা। চানের ঘরে চোরা দরজা, মাটির নীচে গলিখুঁজি, গোপন ঘরে বাক্স-প্যাটরা– এসব চোরাই মাল নাকি?
ঘরে এমনি চুপচাপ যে একটা আলপিন ফেললে শোনা যায়।
বুড়ি বললে, কেন, তাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তো দিন ধরিয়ে। বাইরেই তো পুলিশের সঙ্গে আপনাদের আত্মীয়-স্বজনরা ঘোরাফেরা করছে, ডাকুন-না ওদের।
শ্যামাদাসকাকা আর বিরিঞ্চিদা ঠানদিদিকে বলতে লাগল, কী দরকার ছিল তোমার এসবের মধ্যে নাক গলাবার? এখন আসুক পুলিশ, আসুন সেজোদাদামশাই, আসুন পিসেমশাই, তুমি ঝোলো, আমরাও ঝুলি।
পকেটে এক কুচি চুইংগাম সেঁটে ছিল, সেটিকে বের করে, লোম ছাড়িয়ে মুখে পুরতে যাব, অমনি বন্ধ দরজায় আবার ঠেলা। বাইরে থেকে মোটা গলার ডাক শোনা গেল, দরজা খুলুন মশাই, আমরা পুলিশের লোক। না খুললে বোমা দিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকব।
ঘরময় চুপচাপ। বাক্সের ভেতরে, বাক্সের পিছনে, হারমোনিয়ামের পাশে, পর্দার আড়ালে, যে-যেখানে পারল লুকিয়ে পড়ল। রোগা ভদ্র লোক আর তার ঝাকড়াচুল ছেলে তর তর করে অন্য একটা মাচায় চড়ে বসল।
বাইরে থেকে বোধ হয় ইন্সপেক্টরবাবুই হবেন, হাঁক দিয়ে বললেন, যে দরজা খুলবে তাকে পাঁচ টাকা দেব।
তারপরই একটা অদ্ভুত গাঁক-গাঁক শব্দ, ওরে বাবা রে! মেরে ফেললে রে! খেয়ে ফেললে রে! ওরে হারান হতভাগা, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে, শুট কর–উ হু হু হু! কামড়ে দিয়েছে রে! এই শুট কর, শুট কর।
দাড়িওয়ালা এক দৌড়ে দরজা খুলে হাট করে দিল। ব্যস্ত হয়ে ডাকতে লাগল, আ-আ-আ, টেঁপি-টেঁপি-টেঁপি, কিত-কিত-কিত, আয় টেঁপি-টেঁপি তি-তি-তি।
আর দেখতে দেখতে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল লাল চোখওয়ালা, ভীষণ হিংস্র চেহারার সেই গোরুটা, সঙ্গে আবার ঠিক তারই মতন দেখতে একটি বাচ্চা।
দাড়িওয়ালা তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল, ওরে আমার সোনামুখো বেচারারা। তোদের সঙ্গে দুষ্ট লোকেরা কত খারাপ ব্যবহারই-না করেছে। আহা বাছা রে, একেবারে মুখগুলো শুকিয়ে গেছে।
পুলিশরা যে গোরর ভয়ে কে কোথায় ভেগেছে তার পাত্তা নেই।
এদিকে টেঁপি আর টেঁপির বাচ্চা, খিদের চোটে, বুড়োর পেন্টেলুনটাই খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে।
এই টেঁপি কী হচ্ছে কী। টেঁপি সাবধান। নাঃ, এ তো ছাড়ে না দেখি– দাঁড়া, তোদের খাবার ব্যবস্থা কচ্ছি।
এই বলে বুড়ো ভাঙা মাচার দড়ি খুলে, তাই দিয়ে গোরু দুটোকে বেঁধে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। আমরাও দারুণ একটা সোয়াস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, যে-যার জায়গা থেকে বেরিয়ে এলাম। এতক্ষণ বাদে আমিও চুইংগামটাকে আঙুল থেকে ছাড়িয়ে মুখে পুরলাম।
অমনি একটু কাষ্ঠ হেসে ইন্সপেক্টরবাবু, গোটা দশ পুলিশ, সেজোদাদামশাই আর বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই ঘরে এসে ঢুকলেন। চমকে গিয়ে চুইংগামটা চেবাবার আগেই গিলে ফেললাম। ধেৎ।
১২. সারি সারি তো সব
সারি সারি তো সব এসে ঢু। এদের হাত থেকেই পালাবার জন্যে কাল থেকে কী না করা হয়েছে। যাক গে, ঘরের মধ্যে যারা ছিল, তারা ঝগড়াঝাটি ভুলে দল বেঁধে, তৈরি হয়ে নিল। প্রথমে দাঁড়ালেন জমিদারবাবু, তার পাশে ঠানদিদি, তারপর শ্যামাদাসকাকা, তারপর বিরিঞ্চিদা, তারপর বুড়ি, তারপর ঝাকড়াচুল, তারপর রোগা বেচারা আর সব শেষে, একটু পেছনের দিকে সরে, আমি।
ঘরের মধ্যে দেখলাম এ ছাড়াও বারো-চোদ্দোজন লোক।
ইন্সপেক্টরবাবু পকেট থেকে একটা ছোটো কালো খাতা আর লাল পেনসিল বের করে বললেন, কোথা থেকে যে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি নে। ভুবনডাঙার ঠ্যাঙাড়েরা ধরা পড়বার পর একসঙ্গে এতগুলো ক্রিমিনাল দেখা গেছে কি না সন্দেহ।
পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল, সে দেখলাম খোশামুদের একশেষ, একগাল হেসে বললে, হাঁ স্যার, দেখবেন এবার খবরের কাগজে আপনার নাম বেরুবে। একটা চক্র-টক্রও পেয়ে যেতে পারেন, বলা যায় না, হয়তো তিসরা বিভাগ।
-ওই ছোটো ছেলেটাকে দিয়ে শুরু করে দিন স্যার, কচি আছে, ধমক-ধামক করলে হয়তো একটু-আধটু সত্যি কথা বললেও বলতে পারে।