বার বার বললাম, বাড়িতে পুলিশ ঢুকিয়ো না, ওতে দেশের অমঙ্গল হয়। তার ওপর আমার পেট কামড়াচ্ছে, আমি কাউকে ডাকতে-টাকতে পারব না। কিন্তু কে শোনে! ভাইকে পাঠিয়ে গোটা থানাটাকে বাড়িতে তুলে আনলেন, মশায়!
তারপর ধরপাকড় খানাতল্লাশি। মালা তো পাওয়া গেলই না, উপরন্তু আমার অমন ভালো বামুন ঠাকুরটা রাগ করে দেশে চলে গেল, এখন সে ফিরলে হয়– হঠাৎ এ-মালাটাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম, বুঝলেন? ভয় ঢুকে গেছিল, মালাটা বুঝি পাওয়াই গেল আর টাকাগুলো হাতছাড়া হল। না, না ব্যস্ত হবেন না, এটা মোটেই গিন্নির মালা নয়।
আমি চুপ করে থাকতে না পেরে বললাম, তাহলে শেষপর্যন্ত চুরি হয়েছিল কী করে?
-আরে সেই তো হল সমস্যা। কেমন করে চুরি হল জানা থাকলে কে চুরি করল জানতে আর কতক্ষণ? মোট কথা, সেটিও সিন্দুকে নেই, আর গিন্নিও এমনি কাণ্ড লাগিয়েছেন যে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এতটা ভাবিনি।
বিরিঞ্চিদা তখন গায়ে পড়ে বলল, মালা হয়তো আমরা খুঁজে দিতে পারি।
কোথায় খুশি হবেন, না, তাই শুনে জমিদার বিরক্ত হয়ে বললেন, থা মশাই, আপনাদের আর পরোপকার করতে হবে না।
বুড়ো, বুড়ি আর রোগা ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। হঠাৎ তাদের দিকে ফিরে জমিদারবাবু বললেন, আচ্ছা, মাকড়িপরা বাবরিচুল, ছোকরা কাউকে চেনেন আপনারা?
শুনে আমরা চার জন তো চমকে উঠলামই, ওরা তিন জনও কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।
জমিদারবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, চেনেন নাকি তাকে?
বুড়ি সাদা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ফিসফিস করে বলল, কেন? তাকে দিয়ে আপনার কী দরকার?
–মানে তার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কাজ ছিল। সে যে আমাকে কী বিপদেই ফেলেছে, পেলে একবার দেখে নিতুম।
বুড়ি কিছু বলবার আগেই রোগা ভদ্রলোক বাক্সের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে বিষম রেগে বললেন, আচ্ছা, কে কাকে দেখে নেবে দেখা যাবে। তার ডান হাতের একটি থাপ্পড় খেলে, আপনার ওইসব জমিদারি চাল ঘুচে যাবে।
–ও হো! তাহলে তাকে চেনেন দেখছি।
ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
না, মশায়। বলছি তাকে আমরা চিনিও না, শুনিও না, চোখেও দেখিনি, সে এখানে থাকেও না।
বুড়িও হঠাৎ ফোঁৎ ফোঁৎ করে কেঁদে ফেলে বললে, সে তো আপনার কোনো অনিষ্ট করেনি। এসমস্ত কেবল তাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা। মোটেই আমরা তাকে চিনি না, আর মোটেই সে কাল সন্ধ্যে থেকে এখানে নেই। উঃ! আপনারা কি পশু না পাষণ্ড?
জমিদারবাবু তো এত কথা শুনে ভারি অপ্রস্তুত। ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, আহা, আপনি কেন ও-রকম কচ্ছেন বলুন তো। আমিও তো তাকে ভালো লোকই ঠাউরেছিলাম, কিন্তু কী যে বিপদে ফেলে দিল আমাকে। সামনে জেলখানার লোহার দরজা আর পিছনে গিন্নি।
তারপর মালাটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, এ মালাটার সঙ্গে যে সাদৃশ্য আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এ সে নয়। সে মালা কি আর আমি চিনি নে? আগে ঠাকুমা পরে থাকতেন আর আমার মা হাঁ করে চেয়ে থাকতেন। তারপর ঠাকুমা বুড়ি হলে, মা পরে থাকতেন আর গিন্নি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন। এখন মা বুড়ি হয়েছেন, গিন্নি ওটাকে পরে থাকেন। লাখ টাকা দিয়ে ইনসিওর করা, কিন্তু আজকালকার চোরগুলো পর্যন্ত এমনি ওয়ার্থলেস যে সামান্য একটা লোহার সিন্দুক খুলতে পারে না। আরে ছো, ছো, আজকালকার চোরদের ওপর পর্যন্ত নির্ভর করা যায় না, মশায়।
ভাবতে পারেন শাশুড়ির আগে তার শাশুড়ি, তার আগে তার শাশুড়ি এমনি করে মুক্তোর মালা গলায় ঝুলিয়ে, শাশুড়ির লাইন চলে গেছে সেই মান্ধাতার আমল পর্যন্ত। কিন্তু এবার বাছাধনরা জব্দ! গিন্নি হলেন লাস্ট ম্যান। ওই ছেলেটার সঙ্গে যদি কেউ আমার দেখা করিয়ে দেয়, তাকে এখুনি দশ টাকা দিই।
এ-কথা বলবামাত্র দাড়িওয়ালা এক গাল হেসে এগিয়ে এসে বলল, কই দশ টাকা? দেখি?
বুড়ি আর রোগা ভদ্রলোক তার কোমর জাপটে ধরে তাকে আটকে রেখে চাঁচাতে লাগল, না, না, সে এখানে থাকে না, তাকে আমরা চিনি না। এ লোকটা ভারি মিথ্যাবাদী, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।
বুড়ো ওদের হাতের মুঠোর মধ্যে থেকে দাড়ি ছাড়তে ছাড়াতে বলল, কে মিথ্যাবাদী? কাল রাত্রে কে খেয়েছিল দুধের সর? আমি সাক্ষাৎ বড়ো ভাই হয়ে, সারা দিন খেটে মরি, আর কে এলেই মাছের মুড়ো পায়? নিজেদের গোরুর ভয়ে জুজু, আবার সে-ই খায় ক্ষীরের চাচি? কই, দেখি তো আপনার কাছে সত্যি দশ টাকা আছে কি না, দেখি আপনার মনিব্যাগটা।
তখন জমিদার মাথাটাথা চুলকিয়ে বললেন, ইয়ে মানে আমার মনিব্যাগে সত্যিই দশ টাকা আছে, কিন্তু সেটা আমার সঙ্গে নেই। আসবার সময় তাড়াতাড়িতে ইয়ে–
বুড়ো তো রেগে আগুন।
বেশ, মশায়, বেশ। কাজ বাগাবার ফন্দিটে তো মন্দ নয়। যান, ওকে আমরা কেউ চিনি না। আগে দশ টাকা ফেলুন, তারপর ভেবে দেখা যাবে। কত কথা তো আগে ভুলে যাই, আবার পরে মনে– উঃ।
বুড়ির হাতের প্রচণ্ড চিমটি খেয়ে তবে তার মুখ বন্ধ হল।
ঠিক এই সময় ওপর থেকে খচমচ করে কতকগুলো কাঠকুটো নীচে পড়ল।
সবাই অবাক হয়ে ওপর দিকে তাকাতেই, রোগা ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, ও কিছু নয়, আমি এতক্ষণ মাচাটার ওপর বসেছিলুম কিনা, তাই ওটা দুলছে আর কাঠকুটো ভেঙে পড়ছে। কী মুশকিল। সবাই ওপরে তাকাচ্ছেন কেন? নীচের দিকে চেয়ে দেখুন, একটা বালিশও আমার সঙ্গে পড়েছে কী জ্বালা, তবু চোখ নামায় না।