দাড়িওয়ালা চেঁচিয়ে বলল, যা খুশি বললেই তো আর হল না। মালার রংই তো জানো না। বিশ্বাস না হয় এই দেখো।
বলে বাক্সের ডালাটা খুলে ফেলে দিয়ে মালা বের করে তুলে ধরল।
আধ-অন্ধকার ঘরে মুক্তোর ছড়া জ্বলজ্বল করতে লাগল।
বুড়ো আবার একটা ছোটো মোমবাতি জ্বালতেই বুড়ি অবাক হয়ে দেখল মধ্যিখানের পাথরটা সত্যিই নীল।
অনেকক্ষণ তার কথা বলবার শক্তিই ছিল না, তারপর বলে উঠল, না না, এ সে মালা নয়। এর জন্য আমি সারা রাত জেগে কাটাইনি। তোমরা ভুল মালা এনেছ।
ঠিক এই সময় ঘরের ছাদে কী যেন মড়মড় করে উঠল। ছোটো মোমবাতি, তার আলো ছাদ অবধি পৌঁছোয় না। দারুণ ঘাবড়ে গেলুম সবাই।
ঠিক সেই সময় ঘরের ছাদ থেকে কীসব ভেঙে-টেঙে, ঝুপ করে একটা জিনিস মাটিতে পড়ল।
অবাক হয়ে দেখলাম সেই খোঁচা-দাড়ি রোগা ভদ্রলোক, যাকে পুলিশরা ভুল করে ধরেছিল।
চিঁ চিঁ করে বললেন, বাবা। ঝুলে ঝুলে হাতের মাসিলগুলো সব টেনে লম্বা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস হাসতে হাসতে পড়েই গেলাম। মনে হল ঘরের ভিতরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে, বোধ। করি লোকের ভিড়ে।
বুড়ি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, অত হাসির কারণটা কী, শুনতে পারি?
ভদ্রলোক বললেন, তুমি গো গিন্নি, তুমি। লালপাড় গরদ পরে, মুক্তোর মালা গলায় ঝুলিয়ে, তোমার কেমন ধারা রূপ খুলবে ভেবে, হাসতে হাসতে প্রায় মরেই গেছলাম।
আমি কান খাড়া করে ছিলাম, এবার না জানি কী হবে।
বুড়ি কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। মালার দিকে চেয়ে ঘুম ঘুম সুরে বলতে লাগল, সমুদ্রের তলায় বালির ওপর ঝিনুক পোকা পড়ে থাকে। খোলার ভেতরে সমুদ্রের বালির কণা ঢুকে যায়। ওর গা কুটকুট করে, তাই সাদা চকচকে রস বের করে, তাই দিয়ে বালির গা ঢেকে দেয়, বালির গা মোলায়েম হয়ে যায়। ঝিনুক পোকার আরাম লাগে। তারপর একদিন, মাথার ওপর কাচ-লাগানো বালটি-মুখোশ পরে, বাতাসের নল নাকে লাগিয়ে, জলের তলায় নেমে গিয়ে, ডুবুরিরা ওই মুক্তো তুলে আনে। তাই দিয়ে মালা গাঁথিয়ে, জমিদার গিন্নি পরেন। কিন্তু এ-মালা সে-মালা নয়।
কেন যেন বাইরের গোলমাল থেমে গিয়েছিল। সবাই একটু আশ্বস্ত হল, মালাটা বুড়োর হাতে রইল।
বিরিঞ্চিদা ব্যাপারটাকে বুঝিয়ে বললে, অন্ধকার গর্ত দিয়ে যখনি পড়ে গেলাম, তখনি জানি আমাদের কপালে দুঃখ আছে। তার ওপর ঠানদিদি পড়লেন আমার ঠিক পেটের ওপর। উঃ, নাড়িভুঁড়ি যে এলিয়ে যায়নি সেই যথেষ্ট। দেখতে রোগা হলে কী হবে, কম ওজন ওঁর!– যাক গে, গলি দিয়ে হাঁটছি, তো হাঁটছি, আবার পেছনে শুনি কীসের পায়ের শব্দ। পাঁই পাঁই করে ছুটে, এ-ঘরে ঢুকে, যে যেখানে পারলাম সেঁধোলাম। ওই গলিতে ডালকুত্তা ছাড়া আছে। তার চোখ জ্বলছে দেখলাম। আর তোরা এখানে খাওয়া-দাওয়া করলি।
বুড়ো বললে, ধেৎ, কীসের বীরপুরুষ। ও ডালকুত্তো হতে যাবে কেন, ও তো টেঁপির বাচ্চা।
–টেঁপি আবার কে?
-কেন আমাদের গোরু।
তাই শুনে সবাই খানিক চুপ করে রইল।
তখন শ্যামাদাসকাকা বলতে লাগল, আচ্ছা, এত জিনিস এরা পেল কোত্থেকে?
কারো মুখে রা নেই। আমরা মোমবাতি নিয়ে ঘরময় ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলাম। একসঙ্গে এত ভালো ভালো জিনিস আমি কখনো দেখিনি।
হঠাৎ বাইরে বিকট চিৎকার। বাঁচাও! বাঁচাও! মেরে ফেললে রে। ওরে বাবা রে। মরে গেলাম রে।
এ আবার কী? বুড়ির দয়া হল, ঠানদিদির বার বার মানা সত্ত্বেও দিল দরজা খুলে। হুড়মুড় করে এসে ঢুকলেন ফর্সা, মোটা, কোঁকড়াচুল, সম্পূর্ণ এক অচেনা ভদ্রলোক। মিহি ধুতি পরা, কোচ-দোলানো, হাতে হিরের আংটি, সামনের চুল বেজায় লম্বা, এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর পড়েছে, ভয়ে সারা গা বেয়ে ঘাম ঝরছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, হাত-পা কাঁপছে।
ধপ করে একটি বাক্সের ওপর বসে পড়তেই, ইনি আবার কোনো নতুন বিপদের কথা বলেন, তাই শোনবার জন্য, আমরা সব ঘিরে দাঁড়ালাম।
ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ভাগ্যিস প্রাণটা রক্ষা করলেন! আরেকটু হলেই যে গোরুতে খেয়ে ফেলেছিল আমাকে। এতকাল মা কালীকে ফি-বছর জোড়া পাঁঠা দেওয়া সত্ত্বেও আরেকটু হলেই গোরুর পেটে গেছিলাম।
বুড়ি তখন দাড়িওয়ালাকে সে কী ধমক। আবার টেঁপিকে ছেড়ে দিয়েছ? এখন বাচ্চা যদি সব দুধ খেয়ে ফেলে, কাল সকালে কী করে চা হবে শুনি? মোটা ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, কাল সকাল অবধি বাঁচলে পর তবে তো চা খাওয়া হবে।
১১. ওই কথা বলে যেই
ওই কথা বলে যেই না ঘাড় ফিরিয়েছেন মুক্তোর মালার ওপর চোখ পড়েছে। ভীষণ চমকে উঠলেন, সাপ দেখলে মানুষেরা যেমন চমকায়।
ও কী, ওটা কোথায় পেলেন?
তারপর ঝুঁকে পড়ে ভালো করে দেখে বললেন, নাঃ, সেটা নয়, এটা অন্য মালা। তাতে অন্য পাথর।
তখন বিরিঞ্চিদারা সবাই মিলে তাকে চেপে ধরল, কী মালা, কেমন মালা, খুলে বলতেই হবে। সবাই মিলে হয়তো-বা সাহায্যও করা যেতে পারে।
বিরিঞ্চিদারা সাহায্য করবে শুনে আমার দারুণ হাসি পেল।
ভদ্রলোক বললেন, আমি হলাম সেই জমিদার, যার গিন্নির মুক্তোর মালা চুরি গেছে। বুঝলেন, বেশ একটা মোটা টাকার ইসিওর ছিল, খোয়া গেলে সেটি পাওয়া যায়, তা গিন্নি দিনরাত মালা আগলে রাখবেন। শেষপর্যন্ত গেল তো গেল, অত একটা হাঁকডাক করবার মতোও কিছু নয় কিন্তু গিন্নির সে কী চ্যাঁচামেচি।