বুড়ি বললে, সে আমি কি জানি? আমি কি তাদের বটিগাট? তাদের কত কাজ। এখন তারা খানাতল্লাশি করতে করতে, তোমার ঘর অবধি পৌচেছে। দেখে এলাম তোমার বাক্স খুলে তোমার বিড়ি খাচ্ছে আর তোমার খাটে বুটপরা ঠ্যাং তুলে, তোমার ডাইরি পড়ছে। কীসব লিখেছ বানান ভুল।
বুড়ো তো দারুণ রেগে গেল।
–বেশ করেছি বানান ভুল করেছি। তোমার দাদা হই না আমি? তুমি এখানে কেন?
–আহা, আমি তোমার ডাইরি পড়া শুনি, আর তুমি এদিকে আমাদের সকলের চোখে ধুলো দিয়ে, জিনিসপত্রগুলো নিয়ে ভেগে পড় আর কী! উনি আর খোকা আর আমি পথে দাঁড়াই, তোমার তো তাই ইচ্ছে।
তারপর আমার ঠ্যাং দেখতে পেয়ে বললে, বাঃ! এরই মধ্যে সাকরেদও পাকড়ে ফেলেছ দেখছি।
বুড়ো কী যেন বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময় শোনা গেল মেলা লোকের জুতোপরা পায়ের মচমচ শব্দ।
অমনি এদের দু-জনারই মুখ একেবারে পাংশুপানা! নিঃশব্দে ঘরের ভেতর আমাকে সুষ্ঠু টেনে নিয়ে, দরজা বন্ধ করে আগল দিয়ে দিল।
কারো মুখে কথাটি নেই, বুক ঢিপঢিপ! বাইরে এবার সত্যি সত্যি মেলা লোকের পায়ের শব্দ শোনা গেল।
১০. এবার যারা এল
এবার যারা এল কে জানে তারা বন্ধু না শত্রু। তবু মনে হল ঘরের এরা দু-জন ওদের চাইতে ঢের ভালো। বুড়ি কি ভালো রান্না করে।
বাইরে থেকে ধাক্কাধাকি, আর সে কী চাঁচামেচি! কিন্তু ওই বিশাল দরজা, তার এমনি ভারী পাল্লা, ভাঙে কার সাধ্যি!
এমনি সময় ঘরের ভেতর থেকেই কানে এল ঘড়-ঘড় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ! পিলে চমকে উঠল। ইকী-রে-বাবা। বুড়ি গিয়ে অমনি দাড়িওয়ালার পেছনে লুকিয়ে পড়ল।
আমি কী করি? বড়ো একটা বাক্সের ঢাকনি খুলে তার ভেতরেই লুকোতে গেলাম। কী সর্বনাশ! বাক্সে ঠ্যাং গলিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম–
বাক্সে একটা মড়া নাকি! বুড়োবুড়ি তো প্রায় অজ্ঞান!
এমনি সময় মড়াটা আস্তে আস্তে উঠে বসল। আমিও তাড়াতাড়ি ঠ্যাংটা টেনে নিলাম।
মড়াটা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি ফিরে এল। বুড়ো একটা দেশলাই জ্বালাতেই চিনলাম সে বিরিঞ্চিদা। উফ, বাঁচা গেল! আরেকটু হলে ভয়ের চোটে মরে গেছলাম।
বিরিঞ্চিদা বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে বেড়ালের মতো গা মোড়ামুড়ি দিল, তারপর জামা কাপড় ঝেড়েঝুড়ে কাষ্ঠহাসি হাসল।
তখনও কিন্তু সামনে ঘড়-ঘড় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে আমার সাহস বেড়ে গেছিল, ঢকঢক করে আর দুটো বাক্সের ঢাকনা খুলে দিলাম।
দেখি একটার মধ্যে ঠানদিদি মুচ্ছো গেছেন, আরেকটিতে শ্যামাদাসকাকা দিব্যি কুণ্ডলী পাকিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। মনে হল সত্যি সত্যি ঘুমুচ্ছে।
বিরিঞ্চিদা খোঁচা মারতেই সে উঠে বসে, চোখ না খুলেই বলল, মালা পাওয়া গেছে?
–মালা দিয়ে কী হবে? সে তো তোমাদের নয়।
শ্যামাদাসাকা চোখ খুলে বললে, তোমাদেরও নয়।
আমি বললাম, বাইরে কিন্তু বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই, সেজোদাদামশাই, পুলিশ পেয়াদা। তার কী হবে?
তাই শুনে যে যেখানে পারল একেবারে বসে পড়ল!
বিরিঞ্চিদা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশাই কি একাই এসেছেন?
বললাম, বলছি সঙ্গে সেজোদাদামশাই, পুলিশ-টুলিশ মেলা লোক খাপেঝাঁপে।
বিরিঞ্চিদা একটু আমতা আমতা করে বলল, সবাই কি পুরুষ মানুষ?
দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে বিরিঞ্চিদা কি পাগল হয়ে গেল শেষটা?
বুড়ি বললে, মালাটা কোথায়? ওর তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
দাড়িওয়ালা বিরক্ত হয়ে উঠল, মালা তো আর তোমাদের নয়।
এই বলে যে বাক্সে মালা ছিল, তার ওপর চেপে আরাম করে পা উঠিয়ে বসে পড়ল।
আমি বললাম, ঠান্দিদির মুচ্ছো ভাঙানোর কিছু হবে না?
শ্যামাদাসকাকা বললে, থাক-না, কী দরকার। উঠলেই তো বাজে বকবেন।
বলবামাত্র ঠানদিদি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বাক্স থেকে বেরিয়ে বললেন, ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া, তোমার সব কথা যদি বলে না দিই–
শ্যামাদাসকাকা বলল, সাবধান, শেষটা নিজে সুদ্ধু না জড়িয়ে পড়।
তখন কী রাগ সকলের! দেখতে দেখতে ঘরের মধ্যে দুটো দল হয়ে গেল। এক দিকে বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা, ঠানদিদি; অন্যদিকে বুড়ি আর দাড়িওয়ালা। মাঝখানে আমি।
বিরিঞ্চিদা আবার জিজ্ঞেস করল, সেজোদাদামশাইকে কি একলা দেখলি নাকি? সঙ্গে বামুন-টামুন কিংবা লাল শাড়িপরা মেয়ে-টেয়ে নেই তো?
বললাম, কই না তো। তবে পুলিশরা সব আছে।
বুড়ি খানিক এপার-ওধার খুঁজে বলল, বল-না মালাটা কোথায়?
বুড়ো আবার বললে, বলছি মালা তোমার নয়।
বুড়ি বসে পড়ে বলতে লাগল, নয়ই-বা কেন বলো? জমিদারগিন্নিরই-বা হবে কেন? কতবার দেখেছি তার ফর্সা মোটা গলায় ছোটো ছোটো পায়রার ডিমের মতো শোভা পাচ্ছে। মাঝখানে একটা এই বড়ো সাদা পাথর ধুকধুক করছে। আচ্ছা তুমিই বলো, রংটাই যা ফর্সা, নইলে আমার চাইতে কোন বিষয়ে উনি ভালোটা তাই বলল।
বুড়ো কাষ্ঠহাসি হাসল।
–তোমার যা বুদ্ধি। ইয়ে তা ছাড়া মাঝখানের পাথরটা মোটেই সাদা রং নয়, সেটা নীল। বুড়ি তো অবাক।
–বল কী? আমি জানি না কী রঙের? কতবার দেখেছি পুজোর সময় ঠাকুরবাড়িতে। যতবার দেখেছি ততবার মনে হয়েছে আমিও ওইরকম চওড়া লাল পাড়ের গরদ পরে, কপালে এই বড়ো সিঁদুরের ফেঁটা এঁকে, পায়রার ডিমের মতো বড়ো বড়ো মুক্তোর ওই মালা গলায় ঝুলিয়ে, ঠাকুরবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসি, আর সবাই দেখতে থাকুক আর হিংসেয় ফুলে ফুলে উঠুক।