এদিকে সময় আর কাটতে চায় না। বাইরে চনচনে রোদ, মনে হচ্ছে বেলা এগারোটাও হতে পারে, বারোটাও হতে পারে। স্কুলের দিনে এর কত আগে আমি খাই।
অথচ এখন অবধি অন্য লোকগুলোর কোনো সাড়াশব্দই নেই! বাড়ি ছেড়ে তারা যে জঙ্গলের মধ্যে তোলপাড় করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ভেবে অবাক হচ্ছি বিরিঞ্চিদারা তাহলে গেল কোথায়। শেষটা হুলিয়াতে খেয়ে নেয়নি তো!
এমনি সময় পুলিশের এক জন আমার কাছে এসে, পিঠে হাত-টাত বুলিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলতে লাগল, আরে ভাই, বোলো না ওলোককো কঁহা গুম কিয়া! তোমকো লজেঞ্চুষ দেগা, লাঠি দেগা, লাটু দেগা–
এত এত ঘুষ দেখাতে লাগল, এমনি খারাপ!
হঠাৎ ঝড়ের মতো দাড়িওয়ালা বুড়োটা এসে ঘরে ঢুকল। হাত-পা-বাঁধা লোকটাকে দেখে রেগেমেগে পুলিশদের বলল, স্টুপিড় কাঁহিকা; চোর ধরতে সব দেখছি সমান ওস্তাদ। আবার আমাদের কর্তাবাবুকে ধরে এনে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরজন্যে এক-একটাকে যদি কুড়ি বছর করে জেলে যেতে না হয় তো কী বলেছি। আর কর্তামশাইকেই জেলে দিবি তো আমার বাকি মাইনেটা কি তোরা দিবি না কে দেবে শুনি!
পুলিশদের আর মুখে কথাটি নেই! বুড়োও কারো অপেক্ষা না রেখে, দড়ি-দড়া খুলতে লেগে গেল। দড়ি খোলা হয়ে গেলে বললাম, ওর মুখ থেকে পাগড়ি বের করে দাও, নইলে কথা বলবে কী করে?
কিন্তু লোকটাকে হাঁ করিয়ে দেখা গেল, মুখে পাগড়ি-টাগড়ি কিছু নেই, কখন সেটা চিবিয়ে গিলে-টিলে বসে আছে!
পাগড়ি গেলার কথা শুনে পুলিশরা বেজায় রেগে গেল। এক জন তো বার বার বলতে লাগল গিলে ফেলেছে আবার কী! ওতে নাকি তার ধাবির হিসসে লেখা ছিল, এখন কী হবে।
ততক্ষণে রোগা লোকটার মুখে কথা ফিরে এসেছে, সেও রেগে বলল, গিলেছি মানে আবার কী? গলা দিয়ে নেমে গেলে আমি আর কী করতে পারি বল? অবশ্যি খেতে যে খুব খারাপ লেগেছে তা বলছি না। বেশ টক-টক নোনতা-নোনতা।
এই বলে সে ঠোঁট চেটে, পাগড়ির যে দুটো-একটা সুতো লেগে ছিল সেগুলোকেও খেয়ে ফেলল।
তাই দেখে আমারও এমনি খিদে পেতে লাগল সে আর কী বলব।
দূরে সেজোদাদামশায়ের, বিরিঞ্চিদার পিসেমশাইয়ের গলার আওয়াজ শুনে বোঝা গেল ঠানদিদিদের কাউকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্যি, গেল কোথায় সব, কে জানে হয়তো কিছুতে–
শুনলাম পুলিশ ইন্সপেক্টর বলছেন, দেখতে ছোটো হলে কী হবে, একেবারে কেউটে সাপের বাচ্চা। ও-ই যে এ-সমস্তর গোড়ায় তার কোনোই সন্দেহ নেই, নইলে ওদের এত বুদ্ধি আসে কোত্থেকে।
পিসেমশাইও তক্ষুনি সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমাদের বিরিঞ্চি তো আগে এমন ছিল না। ওই অতটুকু ছেলে দেখে, তাকে বিশ্বাস করে, দেখুন তো মশাই, শেষটা এই অঘোর জঙ্গলে প্রাণটা খোয়ালে।
তাই শুনে সেজোদাদামশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, রেখে দিন, মশাই। আপনাদের বিরিঞ্চিটি কিছু কম যায় না। বউঠানের মাথায় হাত বুলিয়ে
পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, দেখুন, আপনাদের এইসব পারিবারিক ব্যাপারগুলো অতি ছোটো জিনিস। ওই বিরিঞ্চি কি শ্যামাদাস মোলো কি না মোলো, তাই দিয়ে দেশের কীই-বা এসে যায় বলুন। আসল কথা হল জমিদারমশায়ের মুক্তোর মালাটা গেল কোথায়? বড়োসায়েব আর আমায় আস্ত রাখবে না। আর মালা খুঁজে দিতে না পারলে আমার প্রমোশনেরই-বা কী হবে, তাই বলুন?
০৮. তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে
তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে তো সব যে যার ধুপধাপ তক্তাপোশের ওপর শুয়ে পড়ে, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একসঙ্গে বলতে লাগলেন, ইস্! গাল টিপলে এখনও দুধ বেরোয়, অথচ এত বড়ো আরেকটা খুনে বদমায়েশ দুনিয়াতে আছে কি না সন্দেহ! তিন-তিনটে লোককে রাতারাতি একেবারে হাওয়া করে দিল মশায়!
বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সব থেকে খারাপ হচ্ছে যে বিরিঞ্চি হতভাগা আমার সিল্কের জামাটা গায়ে দিয়েই
সেজোদাদামশাই বললেন, স-স-স– ওঁদের বিষয় অমন করে বলতে নেই। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন ইন্সপেক্টর সায়েবের কর্তব্য হল এই ছোকরাকে জেরা করে সব কথা বের করে নেওয়া।
এতক্ষণ রোগা ভদ্রলোক, পুলিশরা আর আমি হাঁ করে তাঁদের কথাবার্তা শুনছিলাম, কিন্তু কিছুতে যোগ দিচ্ছিলাম না। এবার সবাই মিলে একসঙ্গে কথা বলতে লাগলাম।
ইন্সপেক্টর আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল, বনা বাবা কী করেছিস? মালার কথা নিশ্চয় তোর অজানা নেই, বল-না, নিদেন মালাটাই বের করে দে না। কথা দিচ্ছি তোকে ছেড়ে দেব, কেউ তোকে কিছু করবে না, দে দিকি বাপ মালাটা বের করে।
মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। আমি বেচারা ছেলেমানুষ, কিছুই জানিনে, অথচ কে কাকে বোঝায়! ভাবলাম দেখাই যাক একবার স্নানের ঘরে গিয়ে।
আমাকে উঠতে দেখে ওরাও উঠে পড়ল। স্নানের ঘরে ঢুকে ইগল পাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ঘরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি পরীক্ষা করলাম। দেখলাম ওই একটিমাত্র দরজা, উঁচুতে ওই একটিমাত্র শিক-দেওয়া জানলা। তাই তো, ঠানদিদিদের হল কী?
অন্যরা সবাই এগিয়ে এসে, দরজার কাছটিতে ভিড় করে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নীচের তলা থেকে রাঁধাবাড়া ফেলে বুড়িও ততক্ষণে এসে ওদের সঙ্গে জুটেছে দেখলাম!
ওরা তাকে খুব জোরে ফিসফিস করে বলল, চুপ! এ এবার মালা বের করে দেবে, সেই তাদের যা বাকি আছে বের করে দেবে।