ওপরের ডেকে দাঁড়িয়ে জ্যাঠামশাই চারদিকের মনোরম দৃশ্যপট দেখতে লাগলেন। হঠাৎ চোখ পড়ল জাহাজের পাশে বাঁধা একটা ছোট মাছধরার নৌকোর ওপর। তার পাটাতনে তোলা উনুনে টগবগ করে ভাত ফুটছে। পাশে ছোট্ট কড়াইতে কলাপাতা চাপা দেওয়া কী যেন রয়েছে।
একটু পরেই স্নান উপাসনা সেরে, জেলে খেতে বসল। একটা কান-তোলা, চটা-ওঠা কলাই-করা থালায় এক রাশি ধোঁয়া-ওঠা ভাত ঢালল। তারপর কলা-পাতা তুলে, কড়াই কাত করে লাল রগ্রগে কীসের ঝোল ভাতের ওপর ঢেলে দিল। জ্যাঠামশাই দেখলেন প্রকাণ্ড বড় কীসের যেন ডিমের ঝোল। সাধারণ হাঁস-মুরগির অত বড় ডিম হয় না।
লোকটা ডিমটাকে কেবলি পাতের এধার থেকে ওধারে সরায় আর লাল রগ্রগে ঝোল দিয়ে ভাত মেখে, এই বড় বড় গরাস মুখে ফেলে আর উঃ! আঃ! করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে চিবিয়ে গেলে। কিন্তু ডিমটাকে ভাঙে না। শেষটা যখন ঝোল দিয়ে ভাতের পাহাড় শেষ হল, তখন হাত বাড়িয়ে নদীর জলে আঁচিয়ে, ডিমটাকে ভাল করে ধুয়ে-মুছে একটা থলির মধ্যে তুলে রাখল।
এবার জ্যাঠামশাই আর কৌতূহল চাপতে না পেরে, ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওটা কী করলে, ভাইজান?’ ওপর দিকে তাকিয়ে, সে বলল, ‘রোজ শুধু লঙ্কার ঝোল খেয়ে পেট ভরে না, বাবু তাই নুড়িটে দিয়ে রাঁধি।
একেক সময় ভাবি, ভাল খেতে, মন্দ খেতে বলে কিছু নেই; যার যেমন অভ্যেস। পঞ্চাশ বছর আগে শান্তিনিকেতনের কাছে সাঁওতালদের গ্রামে, বিশ্বভারতীর ছেলেরা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছিল। বেশ পড়াশুনো করত ছেলেমেয়েরা।
পুরস্কার বিতরণের দিন সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া হল। আমরা চাঁদা তুলে দিয়েছিলাম। তাই দিয়ে শিঙাড়া জিলিপি কেনা হয়েছিল। পয়সা পয়সা করে ফুলকপির শিঙাড়া, পয়সা পয়সা জিলিপি। ছেলেমেয়েরা মহা খুশি।
পরে একটা ছোট ছেলেকে বললাম, ‘কী রে, জিলিপি শিঙাড়া কেমন লাগল?’ সে এক গাল হেসে বলল, ‘খুব ভাল। কিন্তুক্ মেঠো ইঁদুর আরও ভাল।’
পছন্দের কি আর কোনও নিয়মকানুন আছে? ওই সময় দিনু ঠাকুর একদিন আমাদের দুপুরে নেমন্তন্ন করলেন। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে শুঁট্কিমাছের ঝাল চচ্চড়িও ছিল। আমরা ডাল-ফেলা, পোরে ভাজা, নারকেল চিংড়ি ইত্যাদি খেয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে শুঁটকিমাছটি বারান্দার নীচে ফেলে দিলাম। কিন্তু দিনুদাদা একগ্রাস শুঁটকিমাছ আলাদা করে রেখে দিলেন, পায়েস খাবার পর মুখশুদ্ধি করবেন বলে।
সেই বর্মাতেই বাবা একবার এক মাসের ওপরে ঘোর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে, একদিন সন্ধ্যায় একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছলেন। সেখানে একটা বর্ধিষ্ণু গাঁ। গাঁয়ে সেদিন ঙাপ্পি তোলা হচ্ছে, তার গন্ধে গ্রামে টেকা দায়। শেষটা বাবারা গ্রামের বাইরে যেদিক থেকে বাতাস আসছিল, সেইদিকে তাঁবু ফেললেন।
বাবা স্নান সেরে, তাঁবুর বাইরে, ক্যাম্প-চেয়ারে বসলেন। তাঁর চাকর শশী ঘি দিয়ে লুচি ভাজতে লাগল। এমন সময় গাঁয়ের মোড়ল এসে হাত জোড় করে বলল, ‘ও সায়েব, তোমরা কী রান্না করছ, তার বিকট গন্ধে আমরা টিকতে পারছি না। দয়া করে আর কোথাও উনুন সরাও।’ ততক্ষণ লুচি ভাজা হয়ে গেছিল, কাজেই বাবা তাকে আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠালেন।
গরিবের ঘোড়া-রোগ
আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের গ্রামে এক জমিদার ছিলেন, তাঁর মা নাকি ভারী দয়ালু। কেউ তার ছেলেমেয়ের বিয়ে, বা মা-বাপের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে, বাড়ির দুটো কলা-মুলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে এলে, তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে কত আশীর্বাদ করতেন আর বলতেন, ‘আহা, বেঁচে থাক, সুখে থাক, আমার সতীশচন্দ্রের দোরে চিরকাল খেটেখুটে খেও!’ প্রজারা কৃতার্থ হয়ে বাড়ি যেত।
আরেক জমিদার ছিলেন, তিনি কারও বারণ না শুনে ছেলেকে স্কুলে ভরতি করে দিলেন। গাঁয়ের স্কুল নয়; সেখানে যত রাজ্যের চাষাভুষোর এবং তাঁর নিজের সেরেস্তার মুহুরি, দপ্তরির ছেলেরা পড়ত। তাদের সঙ্গে তো ছেলেকে বসতে দেওয়া যায় না।
তাই তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন, মামার বাড়িতে থেকে, হিন্দু স্কুলে পড়ুক। তাঁর ছেলের প্রাণের বন্ধু মুহুরির ছেলে পাশের গাঁয়ের বড় স্কুলে ভরতি হল। মোসায়েবের মুখে সেকথা শুনে জমিদার রেগে গেলেন, ‘যত্ত সব বাড়াবাড়ি! কেন, গাঁয়ের পাঠশালাটা কীসে খারাপ হল? দেখিস্ তোরা, ওকে পাঠশালার গণ্ডি পার হতে হবে না!’
কয়েক বছর পরে জমিদারের ছেলেকে হিন্দু স্কুল থেকে ছাড়িয়ে, মামার বাড়ি থেকে সরিয়ে, কুষ্ঠিয়ার বোর্ডিং-এ রাখা হল। কলকাতার ছেলেরা নাকি ভারী খারাপ। মামাও আর ছেলেকে রাখতে চাইছেন না।
জমিদার বললেন, ‘স্রেফ হিংসে। আমার জগদীশ সর্দি-কাশিতে এমনি ভুগল যে মন দিয়ে বার্ষিক পরীক্ষাটা দিতে পারল না। দিলে আটকে মাস্টারগুলো! এর ফলে মামার ছেলেও জগদীশের ক্লাসে উঠে এল। পাছে সে জগদীশের চেয়ে কম নম্বর পায়, তাই শালা বলে পাঠিয়েছেন— ও ছেলে রাখা আমার কম্ম নয়।’
মোসায়েব বললেন, এই তো ভাল, কত্তাবাবু। কাছে-পিঠে থাকবে, আনা-নেয়া করতে পারবেন!’
আরও দু’বছর বাদে বোর্ডিং ছেড়ে জগদীশ বাড়িতে এসে বসল। হেডমাস্টার নাকি ভারী খারাপ। ওর অসুবিধা বোঝে না।
মোসায়েব বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে, কত্তাবাবু, ওকে তো আর পরের দোরে চাকরি করে খেতে হবে না। এমন জমিদারি রয়েছে। একটা বাড়ির মাস্টার রেখে দিন, তাতেই হবে। আমার ভাইপোটা তো ম্যাট্রিক পাশ করে, সেই ইস্তক বসেই আছে।’