দিদিমা আরও বলতেন, ছাগলের দড়ি ডিঙোলে নাকি খারাপ কিছু হয়। তা অবিশ্যি হতেই পারে, যদি ঠিক সেই সময় ছাগলটা উঠে পড়ে তেড়ে আসে, কিংবা দৌড় মারে। তিন বামুন একসঙ্গে গেলে নাকি রেলের কলিশন হয়। বিষ্যুৎবারের বারবেলায়—অর্থাৎ বেলা বারোটার পর—যাত্রা করলে কী হয়, সে অভিজ্ঞতা তো আমাদের হাতেনাতে হয়েছিল। শুনুন বলি।
শান্তিনিকেতন থেকে পৌষ উৎসবের পর কলকাতায় ফিরছি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রওনা হয়ে শক্তিগড় ছাড়িয়ে নিরাপদে আরও মাইল বারো গিয়ে, রসুলপুরের লেভেল ক্রসিং-এর কাছে সেই যে গাড়ি বিগড়ে গেল, সে আর চলল না। বাকি দিনটা চেষ্টা চরিত্তির করবার পর যখন বোঝা গেল যে মোক্ষম একটা অংশ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে, কারখানা ছাড়া উপায় নেই। তখন রাত প্রায় দশটা।
বর্ধমানগামী শেষ বাসটার সঙ্গে জাহাজের কাছির মতো মোটা দড়ি দিয়ে গাড়ি বেঁধে, আবার বর্ধমান ফিরে চললাম। সেখানকার কারখানায় সারা রাত গাড়ি সারানোর কাজ হয়।
আমরা বাসে উঠে বসতেই, সামনের সিট থেকে একজন বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু মনে কর না মা, কটার সময় রওনা হয়েছিলে?’
বললাম ‘এই পৌনে একটা হবে।’
মহাখুশি হয়ে তিনি তাঁর পাশে বসা খিটখিটে চেহারার লোকটিকে বললেন, ‘এবার বিশ্বাস হল তো? আপনারা লেখাপড়া শিখেছেন, এসব বিশ্বাস করেন না। বিষ্যুৎবারের বারবেলায় বেরিয়ে এনাদের অমন ভাল গাড়িটার দফা-রফা! আর আপনার মামলার ওইসব জরুরি কাগজপত্র বেমালুম চুরি হয়ে গেল! এক ঘণ্টা আগে বেরোতে কী হয়েছিল? এসব কিছুই ঘটত না।’ আরেকটা গল্প এক বোডিং-স্কুলের দিদিমণি বলেছিলেন। মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, অথচ কিছু কিছু কুসংস্কার মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। ওঁদের বোর্ডিং-এ খাবার টেবিলে এক ছড়া মর্তমান কলা দিয়েছে। তার মধ্যে একটা জোড়া-কলা, তা সেটি কেউ খাচ্ছে না। দিদিমণি ভাবলেন, এই তো কুসংস্কার সম্বন্ধে ছোটখাটো একটা ভাষণ দেবার সুযোগ পাওয়া গেল।
এই ভেবে তিনি শুরু করলেন, ‘জোড়া-কলা খাবে না কেন? কী হয় খেলে?’ বড় মেয়েগুলো এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল। এরই মধ্যে ছোট্ট একটা সাত বছরের মেয়ে বলে উঠল, ‘কিচ্ছু হয় না দেখুন। ওরা বলে নাকি জোড়া-কলা খেলে জোড়া-খোকা হয়। কিন্তু আমি অনেকবার খেয়ে দেখেছি, কিচ্ছু হয় না। জোড়া কেন, একটাও হয় না!’
খাওয়া-দাওয়া
পৃথিবীতে যতরকম আনন্দের ব্যাপার আছে, তার মধ্যে জনপ্রিয়তা আর পরিতৃপ্তির দিক থেকে খাওয়ার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় না। অন্য আনন্দগুলোকে ছাড়তে হলে, হাজার কষ্ট হোক, তবু প্রাণে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু খাওয়া ছাড়লেই অক্কা। তা ছাড়া নিজে খেতে যত না আনন্দ, পরকে খাওয়ানোতে তার চাইতেও বেশি আনন্দ। ভোগে জগতে খাওয়ার মতো জিনিস নেই। আর খাওয়া নিয়ে যেমন সব সরস গল্প শোনা যায় তেমন আর কিছু নিয়ে নয়।
আমার বাবা জরিপের কাজে বর্মার জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছিলেন। সেই সময় ঘোর বনের ধারে এক কাঠগুদামের মালিকের সঙ্গে ভাব হয়েছিল। লোকটি পশ্চিমা বামুন, তার রাঁধবার লোকটিও পশ্চিমা বামুন। মালিক বাবাকে একদিন রাতে খেতে বললেন।
বাবা মহা খুশি। ডাল আর শুকনো আলু আর নিজের হাতে মারা হরিণের মাংস খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছিল। ভেবেছিলেন নিশ্চয় পুরি আর ভাল ভাল ভাজি আর ক্ষীরের মিষ্টি খাওয়া যাবে। গিয়ে দেখলেন সে-গুড়ে বালি। মস্ত মস্ত দুটো বনমোরগ রোস্ট হচ্ছে। চারদিক সুগন্ধে ম-ম করছে। বলাবাহুল্য পুরি ভাজি না পেলেও সেদিনের খাওয়াটা মন্দ হয়নি।
খাওয়ার পর মুখে আমলকীর চূর ফেলে বাবা বললেন, ‘খুব ভাল খেলাম। তবে আমি অন্যরকম আশা করেছিলাম।’
লোকটি হাসলেন, ‘বামনাই খাবার বুঝি? তবে শুনুন আমার কাহিনি। আমরা বংশানুক্রমে ঘোর নিরামিষাশী। এখানে এসে বন্ধুবান্ধবের দলে পড়ে মাছ-মাংস খেতে শিখলাম। কেউ গিয়ে অমনি বাবার কানে কথাটা তুলে দিল। বাবাও পত্রপাঠ আমাদের পৈতৃক বামুনঠাকুরের ছেলেকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন।
‘সে নিজে তো মাছ-মাংস ছোঁবেই না, আমি স্টোভে নিজের মতো বেঁধে খেলেও নাক সিঁটকোবে, নানারকম আপত্তিকর মন্তব্য করবে। ক’দিন আর সহ্য করা যায় বলুন?
‘শেষটা একদিন দুটো মোটাসোটা মুরগি নিয়ে ওর রান্নাঘরে ঢুকলাম। ও হাঁ হাঁ করে তেড়ে এল। আমি বললাম, ‘এ দুটোকে কাট্।’ ও বলল, ‘প্রাণ থাকতে নয়।’ আমি তখন পায়ের চটি খুলে ওকে আগাপাশতলা পেটালাম। ও বলল, ‘কাটছি! কাটছি!’
‘কাটা হয়ে গেলে বললাম, ‘এবার রাঁধ।’ ও বলল, ‘কিছুতেই না।’ আমি চটি খুলতেই ও বলল, ‘রাধছি! রাঁধছি!’ রান্না হলে, দু’ভাগ করে বললাম, ‘অর্ধেকটা তুই খা!’ ও বলল, ‘মেরে ফেললেও না।’ আমি তখন আবার চটি খুললাম। ও-ও সঙ্গে সঙ্গে থালা টেনে নিয়ে খেতে বসে গেল।
‘পরদিন কিছু বললাম না। ভাবলাম একটু একটু করে সইয়ে নিতে হবে। কিন্তু সেদিন ব্যাটা নিজের থেকেই মুরগি কিনে এনে, কেটেকুটে, বেঁধে-বেড়ে, দু’ভাগ করে, বড় ভাগটি নিজের জন্য তাকে তুলে রেখে দিল। সেই ইস্তক খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আর কোনও অসুবিধা হয়নি।’
এই তো গেল সুখীদের গল্প। আমার বন্ধু মীরা দত্তগুপ্তর জ্যাঠামশাই ছিলেন বাবার বন্ধু। সেই করুণা জ্যাঠার কাছে একটা চমৎকার গল্প শুনেছিলাম। উনি ছিলেন নামকরা এঞ্জিনিয়ার। একবার কোনও কাজে চাঁদপুরের ওদিকে যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে ফেরবার পথে, বড় জাহাজে উঠে শুনলেন, তখনও ছাড়তে ঘণ্টা দুই দেরি আছে।