আমরা ভাবি সব বেওয়ারিশ কুকুর একরকম। মোটেই তা নয়। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়দের একটা বড় সাইজের কুকুর ছিল, সে একটু ঝগড়াটে স্বভাবের হলেও, সভা-সমিতি করতে খুব ভালবাসত। একবার এক জায়গায় মাঘোৎসবের উপাসনা হচ্ছে, এমন সময় ওই কুকুর সবাইকে ঠেলেঠুলে একেবারে বুড়ো আচার্যমশায়ের মুখোমুখি ফরাশের ওপর গিয়ে বসল।
তারপর পাক্কা আড়াই ঘণ্টা গান, উপদেশ, প্রার্থনা শুনে সবাই যখন উঠল, ও-ও নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস আচার্যমশাই সারাক্ষণ চোখ বুজে ছিলেন, নইলে চোখ খুলে ছয় ইঞ্চি দূরে ওই কুকুর-মুখ দেখলেই হয়েছিল আর কী!
নাম-করা শিশুসাহিত্যিক অজেয় রায়দের বাড়িতে একটা কুকুর থাকত। হঠাৎ তার চটি খাবার শখ চাপল। চটির বাড়ি নয়, চটির ওপর দিকটা। এখানে সবাই বাইরে চটি খুলে ঘরে ঢোকে। ওদের বাড়িতে কেউ এলে, ঘণ্টাখানেক পরে বেরিয়ে এসে দেখত চটির তলা আছে, ওপরটা নেই! কুকুর ল্যাজ নাড়ছে।
ক্রমে বাড়ির সকলে কুকুরের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠল। বাদে বলাই মুচি। তাকে দিয়ে ওই সব হাফ-খাওয়া চটি সারানো হত। তার কিছু বাড়তি রোজগার হত। সে কুকুরের মাথায় হাত বুলোত, ছিলকেটা বিস্কুটটা খেতে দিত। একদিন কিন্তু তিন জোড়া চটি সারিয়ে পকেটে পয়সা ফেলে, হাসিমুখে বাইরে এসে কুকুরটাকে গাল দিতে লাগল! বলাই যতক্ষণ বাড়ির লোকের চটি সারাচ্ছিল, কুকুর ততক্ষণে বলাইয়ের চটির ওপরটা চেটেপুটে সাবাড় করে রেখেছিল।
কুসংস্কার
আমরা যখন ছোট ছিলাম, মেমদের ইস্কুলে পড়তাম, তখন মাঝে মাঝে আমাদের ফিরিঙ্গি দিদিমণিরা দুঃখ করে বলতেন, ‘তোমাদের জন্য আমাদের বড়ই কষ্ট হয়। কী রকম সুপারস্টিশাস্ তোমরা। ছি ছি! ব্রাহ্মিণরা মরে গেলে, তাদের মাথার চুটকি আকাশের দিকে রেখে, লম্বা গর্তে খাড়া দাঁড় করিয়ে পুঁতে রাখ! মাই গড্!’ অমনি আমাদের আধা-কালো সহপাঠিনীরা বলতে থাকত, ‘হিন্ডুজ্ বিশ্বাস করে তাহলে ডে-অফ-জাজমেন্টে গড্ ওদের টিকি ধরে টেনে সোজা স্বর্গে তুলে নেবেন।’
একথা শুনে আমরা যতই ব্যস্ত হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি বামুনরা মোটেই মরা লোকদের খাড়া করে পোঁতে না। সবাইকে তারা পুড়িয়ে ফেলে। তাতে ওরা ভীষণ শক্ড্! ‘শেম! শেম! ঠাট্টা করেও ওকথা বলতে হয় না। এডুকেটেড লোকরা মরা মানুষদের ভক্তি করে। পুড়িয়ে ফেলে দেয় না!’
আধা-কালো দিদিমণিরা বলতেন, ‘অল হিন্ডুজ বেজায় সুপারস্টিশাস! কী করবে বেচারিরা, হেবেনে তো আর যেতে পারবে না, তা সে যত ভালই হোক না কেন!’ এটা আমাদের অবিচার বলে মনে হত। বলতাম, ‘কেন? ভাল লোকরাও হেবেনে যাবে না কেন?’
‘ওমা, তাও জান না? রোমান ক্যাথলিক ছাড়া কেউ যে হেবেনে যেতে পারবে না। আর সবাই বড্ড পাপী। তবে যদি পাপ স্বীকার করে আমাদের কিছু প্রেজেন্ট দাও, তা হলে পাপ কমে যাবে।’
বাড়িতে গিয়ে মাকে প্রেজেন্টের কথা বলতেই, মা খুব হাসতেন। বলতেন, ‘ওদের বড় কুসংস্কার কিনা’—
‘কুসংস্কার আসলে কী মা?’
‘কুসংস্কার হল গিয়ে সুপারস্টিশন। যেসব বিশ্বাসের কোনও কারণ নেই, তাই মানা আর কী।’ ভারী আশ্চর্য লাগত। ওরা তো আমাদের সুপারস্টিশাস্ বলে। মা আবার উলটো কথা বলছেন! ছেড়ে দিতাম তর্ক।
কিন্তু ছেড়ে দিলেই তো আর হল না। ওরা ছাড়ত না। আমাদের বলত প্রটেস্টান্ট। মা বলতেন, ‘মোটেই না, প্রটেস্টান্টরাও খ্রিস্টান।’ ‘কিন্তু ওরা যে বলে প্রটেস্টান্টরা হেবেনে যায় না।’ ‘ওরা বড্ড গোঁড়া, ক্যাথলিক ছাড়া কাউকে খ্রিস্টান বলেই মানে না। তা ছাড়া হেবেন বলতে কিছু নেই। যারা ভাল কাজ করে, তাদের ভাল হয়। যারা খারাপ কাজ করে, তাদের খারাপ হয়।’
একবার ইস্কুলের হলঘর রং হচ্ছিল। একটা বড় মই দেওয়ালে ঠেকিয়ে, তাতে চড়ে মিস্ত্রিরা দেয়ালে ফিকে গোলাপি রং লাগাচ্ছিল। মেরি নিঢ্যাম তার বন্ধুদের বলল, ‘মইয়ের তলা দিয়ে যেয়ো না। ভয়ানক আন্লাকি!’ পরদিন নিজের চোখেই দেখলাম কত আন্লাকি। দুটো দুষ্টু ছেলে কোনও বারণ না শুনে ওই মইয়ের তলা দিয়েই ছুটে গেল। মইতে ঠ্যাং লটকে গেল, মইটি মিস্ত্রিসুদ্ধ হুড়মুড় করে পড়ল। মিস্ত্রির কনুইতে লাগল আর ছেলে দুটো মাথা থেকে পা অবধি তেলতেলা রং মেখে ভূত!
আরও কত নিয়ম ছিল ওদের। টেবিলে খেতে বসে কেউ নুন ফেললে, আরেক খাবলা নুন নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে ছুড়ে না দিলেই সর্বনাশ! তেরোজন এক টেবিলে খেতে বসলে সাংঘাতিক বিপদ হবে। যিশু নাকি ওই করেই বিপদ ডেকে এনেছিলেন!
একদিন কে জিজ্ঞাসা করল, গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে হিন্ডুজরা কী করে? শৈলবালা বলল, ‘কী আবার করব? কেশে তুলতে চেষ্টা করি। জল খাই, ভাতের দলা গিলি, আলু গিলি, কাঁদি, তবু যদি না যায় ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি একটা সরু লম্বা চিমটে দিয়ে কাঁটা তুলে দেন।’
শুনে ওরা স্তম্ভিত। ‘মাই গড্! ওসব কিছুই করবার দরকার নেই। সত্যি তোমরা বড্ড গোঁড়া। স্রেফ একটা বোলে একটু জল নিয়ে, তার ওপর ছুরি দিয়ে একটা ক্রুশ্ চিহ্ন আঁকলেই বাপ বাপ বলে কাঁটা নেমে যায়! এও জান না? রিয়েলি!’
শুধু ওরা কেন, অন্যরাও নানারকম অদ্ভুত কথা বলতেন। পাশের বাড়ির দিদিমা একদিন তাঁর নাতিদের ডেকে বকাবকি করতে লাগলেন, ‘তোদের কি কোনও আক্কেল নেই? ঠ্যাং ফাঁক করে, মাথা ঝুলিয়ে, ঠ্যাঙের ফাঁক দিয়ে পেছন দিকে ফের তাকাচ্ছিস্! তাই তো তোদের কাকিমার একটার পর একটা খালি মেয়েই হয়!’