ইউরোপে ভ্রমণ করে এসে আমার নতুন দিদি একটা মজার গল্প বলেছিলেন। একটা বিখ্যাত পাহাড়ে শহর। ছোট্ট শহর। সেখানকার এক বিখ্যাত হোটেল। ভারী রোমাঞ্চময় ব্যাপার; চারদিকে চোখভোলানো বরফের পাহাড়; অনেক নীচে নীল হ্রদ; চাঁদের আলোয় একটা লোক গীটার বাজাচ্ছে।
সাদা পোশাক পরা বেজায় মোটা হোটেলওয়ালা নতুনদিদিদের সঙ্গে এসে ভাব করল। বলল, ‘ম্যাডাম, আমাদের বেজায় রোমাঞ্চময় দেশ। আমার গালে এই যে কাটার দাগ দেখছেন, এর পেছনেও একটা প্রেমের ইতিহাস আছে। একটা লোকের সঙ্গে ডুয়েল লড়ার চিহ্ন এটা। বলাবাহুল্য ছয় মাস হাসপাতালে কাটিয়ে, সে ব্যাটা বিদেশে পালিয়েছে। শুনেছি কালকুতা বলে একটা জায়গায় তার মস্ত ব্যাবসা আছে।
আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। আমি সেই অতুলনীয়াকে বিয়ে করে, পরম সুখে হোটেল চালাচ্ছি।’
গল্প শুনে উৎসাহিত হয়ে, নতুনদিদি বললেন, ‘এই বিদেশিনীকে কি একবার দেখতে পাব না? দেশে ফিরে গল্প করব।’
আহ্লাদে গলে গিয়ে হোটেলওয়ালা বলল, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়, ওই তো বড় ট্রে নিয়ে সে এদিকেই আসছে।’
নতুনদিদি ফিরে দেখলেন যত না লম্বা তার চেয়ে চওড়া, মাথায় কয়েক গাছা চুল ঝুঁটি করে বাঁধা, জুতোর বোতামের মতো পিটপিটে চোখ, ঢিবলি নাক, হাঁড়ি মুখ।
অবাক হয়ে হোটেলওয়ালার দিকে তাকাতেই, সে বলল, ‘আশ্চর্য হলেন নাকি? আহা! ওর রান্না তো এখনও খাননি! ওর জন্য একবার কেন, আমি একশোবার যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে রাজি আছি!’
বুঝুন একবার স্বামীদের কী পছন্দ!
হুদিনি ইত্যাদি
ভোজবাজি, ইন্দ্রজাল, ভেলকি। সবই এক; অর্থাৎ নয়কে হয় করা। অন্তত অভিধানে তাই বলে। আসলে তফাত আছে। একটি হল চোখকে ফাঁকি দেওয়া; হাতসাফাইয়ের কারচুপি দিয়ে দর্শককে বোকা বানানো। খুব সহজ ব্যাপার নয়। বিদ্যুতের মতো হাত চাই, দর্শকের মনকে মুঠোর মধ্যে রাখতে পারা চাই।
যেমন অনেক বছর আগে নিউ এম্পায়ারের মঞ্চে দেখেছিলাম, সওয়ারসুদ্ধ একটা মরিস গাড়ি তোলা হল। পিছনে একটা পরদা ঝুলছিল; যদ্দূর মনে পড়ে, তাতে একটা পেট্রল স্টেশনের দৃশ্য আঁকা ছিল।
ফট করে জাদুকর পি সি সরকার ফঁকা পিস্তলের আওয়াজ করলেন, সবাই চমকে উঠলাম। তারপরেই চেয়ে দেখলাম মঞ্চের ওপর পেট্রল স্টেশনের দৃশ্য আঁকা পরদাটা রয়েছে, কিন্তু সওয়ারসুদ্ধ গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে গেছিলাম।
পরে ভেবে দেখেছি হাতসাফাই দিয়ে এটা সম্ভব হতে পারে। ধরুন যদি গাড়ির ঠিক সামনে, মাথার ওপর অদৃশ্যভাবে অবিকল ওইরকম আরেকটা পরদা গুটিয়ে রাখা হয় আর পিস্তলের শব্দে চমকে-ওঠা দর্শকদের এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে, ঝুপ্ করে গুটনো পরদাটিকে গাড়ির সামনে নামিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে পিস্তলের ধোঁয়া পরিষ্কার হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে পরদা আছে, গাড়ি নেই। তাই করা হয়েছিল কি না জানি না, তবে ব্যাখ্যানা হতেও পারে।
আরেক রকম দেখেছি তাকে হাতসাফাই বলা যায় না। তার কোনও ব্যাখ্যানই হয় না। ৫০ বছর আগে সুরুল গ্রামের মাঠে সার্কাসের তাবু পড়েছিল। শান্তিনিকেতন থেকে আমরা দল বেঁধে গিয়ে, চার আনা করে টিকিট কিনে, ছেঁড়া তাঁবুর তলায়, রিং-এর ধারে কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম।
তখন বিজলিবাতি ছিল না এদিকে। ছাদ থেকে মস্ত একটা হ্যাজাক ঝোলানো ছিল। মালিক দু’জন; আর্টিস্ট জনাদশেক; কয়েকটা ঘেয়ো কুকুর, রোগা ঘোড়া আর একটা বেয়াদব চাকর। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে, গোড়াতেই বড় মালিক বলল, ‘এই লোকটা বেজায় বদ, পারলে খেলা নষ্ট করে দেবে। তার চেয়ে এটাকে পুঁতে রাখা যাক! অ্যাই, গর্ত খোঁড়!’
ছোট মালিক বলল, ‘দাঁড়াও, আগে ও হ্যাজাকটা ঝোলাক, তারপর পোঁতা যাবে। নইলে তুমি আমাকে বাতি ঝোলাতে বলবে?’
বাতিটা ঠিকমতো ঝোলানো হল, চাকরটার সাহায্যে গর্তও খোঁড়া হল। দর্শকরা অনেকে উঠে গিয়ে ভাল করে দেখে এল গর্তে কেউ বা কিছু নেই। তারপর চাকরটাকে গর্তে পুরে, মাটি-চাপা দিয়ে, পা দিয়ে বেশ করে চেপেচুপে মাটি শক্ত করে, তার ওপর দেড় ঘণ্টা খেলা দেখানো হল।
প্রায় সবই অতি মামুলি খেলা, তার জন্যে একটা লোককে জ্যান্ত পোঁতার কোনও দরকার ছিল মনে হল না। বিরক্ত হয়ে উঠে যাবার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় শেষ খেলার ঘোষণা শুনতে পেলাম।
বড় মালিক বলল, ‘জিন্দা পুতুলের নাচ দেখাব। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ, তাঁবুতে তালি দেবার পয়সা পর্যন্ত জোটাতে পারি না। জিন্দা পুতুল কিনব কী করে? তাই নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছি।’
এই বলে দু’জনে নিজেদের পকেট থেকে দুটি ময়লা রুমাল বের করে, ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখাল। দর্শকরা কেউ কেউ হাতে নিয়ে দেখল কোনও কারচুপি নেই, কিন্তু জঘন্য নোংরা।
রুমাল দুটি হাতে ফিরে আসতে, বড় মালিক একেকটাতে ছয়টি গিঁট দিয়ে মুন্ডু, কোমর, দুই হাত, দুই পা বানিয়ে, আবার রুমাল-পুতুল সবাইকে দেখাল। তারপর হাতের তেলোয় তাদের পাশাপাশি শুইয়ে বলল, ‘মরা পুতুল তো আর নাচতে পারে না, তাই জ্যান্ত করে নিচ্ছি।’ এই বলে দুটো ফুঁ দিতেই, পুতুল দুটো লাফিয়ে উঠে হাত তুলে সেলাম করে, এ-ওর কোমর জড়িয়ে মালিকের হাতের তেলোয় নাচতে লাগল। নাচতে নাচতে একসময় তিড়িং-বিড়িং করে লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল। নেমে হাত তুলে ঠ্যাং ছুড়ে কতরকম নাচ যে দেখাল, তার ঠিক নেই। আমরা একেবারে থ! কোথাও কোনও সুতোটুতো বাঁধা দেখা গেল না। মালিকরা হাতও নাড়ছিল না।