এই ব্যবস্থাই বছরের পর বছর ধরে চলতে লাগল। বারো বছর পরে এক দিন ছোট বুড়ি পেনশন আনতে গিয়ে দেখে তার জন্য পুলিশের লোক অপেক্ষা করছে। কে তাদের বলে দিয়েছে খোঁড়া বুড়ি দশ বছর হল মারা গেছে আর ছোট বুড়ি দুজনার পেনশন বেআইনিভাবে একা ভোগ করছে। কাজেই আইনমতে তাকে ধরে হাজতে পোরা যায়!
শুনে সে তো কেঁদেকেটে এক-সা করল। কোনও বেআইনি কাজ সে করেনি। দুজনার পেনশন সে একা দশ বছর ভোগ করছে সত্যি, কিন্তু খোঁড়া বুড়ি মারা যাবার আগে তার পেনশনটি উইল করে ছোট বুড়িকে দিয়ে গেছে! এই তো সেই উইল, খোঁড়া বুড়ির নিজের হাতে লেখা। পাড়ার দু’জন বন্ধু সাক্ষী হয়ে সই দিয়েছে। পরের জিনিস সে নিতে যাবে কেন? প্রতি রবিবার সে গির্জে যায়!
পেনশন আপিসের কর্মচারীরা মহা মুশকিলে পড়লেন। ৭৭ বছরের বুড়ি, তার সত্যিই বিশ্বাস বন্ধুর পেনশন তারই প্রাপ্য! কোনও কল্যাণ সমিতির দয়ায়, শেষ পর্যন্ত তাকে হাজতে যেতে হয়নি। তবে বন্ধুর পেনশনও আর পায়নি।
সাপ
ছোটবেলাকার একটা ঘটনা মনে আছে। শিলং পাহাড়ে থাকতাম। কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! বাড়ির তিনদিক ঘিরে একটা আধমানুষ গভীর নালা কাটা ছিল। তাতে বর্ষায় করুগেটের ছাদ থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ত। বাগান থেকে বাড়তি জলও এসে মিশত।
দুটো চ্যাপটা পাথর ফেলে তার ওপর একটা পুলের মতো ছিল। সেটার ওপর দিয়ে বারান্দায় উঠতে হত। তখন শিলং-এ বিজলিবাতি ছিল না। মোমবাতির, তেলের বাতির আলোয় বড় সুখে আমাদের দিন কাটত। এতটুকু অসুবিধা হত না।
একদিন সন্ধেবেলা বাবার দুই বন্ধু গল্পগুজব শেষ করে বাড়ি যাচ্ছেন। ওই পাথরের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময় অমরকাকাবাবু হাতের লাঠি দিয়ে নিজের গোড়ালি খোঁচাতে লাগলেন।
বাবা বললেন, ‘হল কী, মিত্তির?’ কাকাবাবু বললেন, ‘পায়ে একটা দড়ি না কী জড়িয়ে গেছে। কিছুতেই খুলতে পারছি না।’ এই বলে নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করতে যাবেন, বাবা খপ করে তাঁর হাত ধরে ফেলে বললেন, ‘থামো!’ তারপর ‘বাতি! বাতি!’ বলে চ্যাঁচাতেই একটা লণ্ঠন এল।
তার আলোয় দেখা গেল কাকাবাবুর পা বেয়ে একটা কালো সাপ উঠবার চেষ্টা করছে! বাবার হকি-ফুটবল-খেলা পা। সেই পা তুলে ঝপ করে সাপের মাথা মাড়িয়ে মাটিতে চেপে ধরলেন। সাপের গা বিশ্রীরকম পাক খেতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে লাঠিসোঁটা এল, সাপেরও ভবলীলা সাঙ্গ হল। তারপর তাকে লাঠিতে ঝুলিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে ফেলে আসা হল।
এর পঞ্চাশ বছর পরে শান্তিনিকেতনে একদিন আমাদের বারান্দার আলসের ওপর বসে আছি। হঠাৎ দেখি কাক, শালিখ, চড়াই, ঘুঘু, বুলবুলি, সবাই বাগানের মধ্যিখানের ঘাসজমিতে নেমে, মহা নাচানাচি, ডানা ঝাপটানি, কিচিরমিচির লাগিয়েছে!
কী ব্যাপার ভাবছি, এমন সময় ছাদে-বেয়ে-ওঠা বুগানভিলিয়া গাছ থেকে এক হাত লম্বা রামধনু রঙের একটা গিরগিটি থপ করে আমার পাশেই পড়ে, সেখানেই পড়ে রইল। মনে হল নড়বার-চড়বার ক্ষমতা নেই। কিন্তু বুকটা উঠছে পড়ছে।
মানুষের পাশে গিরগিটি বসে আছে, এ আমি ভাবতেই পারি না। অবাক হয়ে ইদিকউদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ কচিকচি ডালপালা ফুলপাতা ভেঙে, আমার ওপর হাতের মতো মোটা, অন্তত ছয় হাত লম্বা, গাঢ় ছাই রঙের একটা সাপ ঝাপুড়-ঝুপুড় করে নেমে এসে, কাঁকরের ওপর দিয়ে কিলবিল করে গিয়ে নিমেষের মধ্যে টগরের বেড়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল!
মিনিটখানেক গিরগিটি আর আমি পাশাপাশি থুম হয়ে বসে থাকার পর, ‘মালি! মালি!’ বলে মহা চ্যাঁচামেচি লাগালাম। মিনিট পাঁচেক পরে মালি এসে বলল, ‘ভয় নেই! ভয় নেই! উনি ধ্যানস। মাঝে মধ্যে কামড়ান, কিন্তু বেশি বিষ নেই!’
চটে গেলাম। ‘বিষ নেই তো পাখিরা নাচছে কেন?’ মালি হাসতে লাগল, ‘উনি ওদের আন্ডা-বাচ্চা খাবেন বলে গাছে উঠেছিলেন, তাইতেই ওদের রাগ। গিরগিটিও খান।’ তারপর হেই! হ্যাশ্হুশ্! করতেই পাখিরা উড়ে গেল। আরও কতক্ষণ পরে গিরগিটিটাও ল্যাজ টানতে টানতে আবার গিয়ে বুগানভিলিয়া গাছে উঠল।
বহুকাল আগের এক গল্প শুনেছি। কুষ্ঠিয়ার কাছে গোরাই নদীর ধারে এক গ্রাম। সেই গ্রামে এক ছোট ছেলে আর তার দিদি তাদের মায়ের কাছে থাকে। বাবা মফস্সলে চাকরি করেন। ওদের দেখাশুনো করে একজন আধবুড়ো লোক। তার নাম জমীরদা। কোনও গুণিনের কাছে শেখা, তার অনেক বিদ্যে জানা ছিল। সে সাপের বিষের ওষুধ জানত, সাপ বশ করতে পারত।
দিদির পাখি পোষার শখ। বাগানে একটা চালাঘরে, কাঠের বাক্সে করে দিদি রাজহাঁস পুষত। দিনের বেলায় গোরাই নদীতে সাঁতার কাটত, পুকুরপাড়ে গুগলি তুলে খেত। রাতে চালাঘরে থাকত। একদিন ভোরে চালাঘরের দোর খুলেই দিদি দেখে একটা হাঁস মরে পড়ে আছে! অমনি সে কান্না জুড়ল। জমীরদা ছুটে এল। মরা হাঁসকে কোলে করে বাইরে আনতেই অন্য হাঁসরাও হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল।
মরা হাঁসকে পরীক্ষা করে জমীরদা বলল, ‘একে সাপে কেটেছে। গোখরো সাপ। আমি ওষুধ আনতে যাচ্ছি। তোমরা চালাঘরে ঢুকো না।’
ঘরে শেকল তুলে দিয়ে জমীরদা ওষুধ আনতে গেল। কিছুক্ষণ পরেই এক হাতে একটা মরা মানুষের হাড় আর অন্য হাতে শুকনো শিকড়ের মতো কী যেন নিয়ে সে ফিরে এসেই সবাইকে বলল, ‘তফাতে যাও! আমি সাপ বের করি!’