ছোকরা অধ্যাপক সহজে ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। সে থানায়-টানায় গিয়ে মহা শোরগোল তুলল। ফলে চোরাই মালের একটা তালিকা তৈরি করে, থানায় থানায় দেওয়া হল। সবাই তাই নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। কিছুদিন কেটে গেল। সবাই। বলল, হ্যাঁ, ওই করে চোর ধরা পড়লেই হয়েছে!
এমন সময় ইলেমবাজারের কাছাকাছি একটা পানের দোকানে থানার একজন ছোকরা সাব-ইন্সপেক্টর পান কিনতে গেছে। হঠাৎ মনে হল পানওয়ালার হাতে বাঁধা হাতঘড়িটাকে যেন চেনা-চেনা লাগছে! পান কেনা হলে, উঠিপড়ি করে ছোকরা থানায় ফিরে গিয়ে, তালিকাটা আরেকবার পড়ে দেখল। হ্যাঁ, এই তো সে-ই!
তখন পুলিশ-পেয়াদা নিয়ে পানওয়ালাকে ধরে জেরা করে জানা গেল যে ওদিককার কোনও গ্রামের একজন চেনা লোক ওই ঘড়িটি বন্ধক দিয়ে একশো টাকা ধার নিয়েছে। সেই চেনা লোকটির ঠিকানা জোগাড় করা হল। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল মস্ত এক চালাঘর। চালাঘরের চার্জে একজন আধাবয়সি মহিলা।
তখন বেশ রাত। মহিলা বললেন, ‘আমার ছয় ভাই এবাড়ির মালিক। তারা নাইট্ ডিউটি করে, বোলপুরের ওদিকে। এখন আমি ঘরটর খুলতে পারব না।’
পেয়াদারা তখুনি বিদায় নিয়ে একটা আমবাগানে গাঢাকা দিয়ে রইল। ভোরে নাইট ডিউটি সেরে, দ্রব্যাদি নিয়ে ছয় ভাই ফিরলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হল। সমস্ত চোরাই মালও উদ্ধার হল। শোনা গেল এটা ব্রাঞ্চ আপিস, হেড কোয়ার্টার কলকাতায়।
আরেকবার বিকেলের গাড়িতে আমাদের প্রতিবেশী অমরবাবু তাঁর স্ত্রী আর শ্যালীকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। ট্রেন দু’ঘণ্টা লেট। পথেই রাত হবে। শীতের বেলা, এখনি অন্ধকার হয়ে আসছে, ওঁরা গাড়ির দরজা-জানলায় ছিটকিনি এঁটে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন।
সেকালের সেকেন্ড ক্লাস গাড়ি। ওঁরা ছাড়া তিনজন যাত্রী। তাদের মধ্যে এক বেচারা বউ ঘোমটা টেনে একধারে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। আর দু’জনের মধ্যে একজনকে বেশ পয়সাওয়ালা ভারীক্কে ধরনের মনে হল। সঙ্গে লটবহর, নতুন সুটকেস, বাজারের থলি তাতে তাজা পালং, মুলো। তৃতীয় ব্যক্তি বোধ হল ওঁরই মোসায়েব। সারাক্ষণ হ্যাঁ কর্তা, যা বলেছেন কর্তা, করছিল।
ওঁদের কথায় মনে হল কর্তার মেয়ের বিয়ের জন্য কলকাতা যাওয়া হচ্ছে। পরিবারবর্গ আগেই চলে গেছে।
কৰ্ড লাইন দিয়ে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে গাড়ি চলেছে। আলো নিবু-নিবু। হঠাৎ অন্ধকারে থেমে গেল। সময়কাল খারাপ৷ সবাই তটস্থ। বউটি একেবারে সিঁটিয়ে গেছে। চারদিক থমথম করছে। তারি মধ্যে হঠাৎ বউটি উঠে দরজার ছিট্কিনি খুলে অন্ধকারে নেমে গেল!
সবাই ব্যস্ত হয়ে ‘হাঁ-হাঁ-হাঁ— ও কী করছেন— ও কী করছেন?’ বলতে না বলতে অন্ধকারে সে মিলিয়ে গেল! আর চারজন সশস্ত্র যুবক কামরায় ঢুকে বলল, ‘যার যা আছে ভালয় ভালয় দিয়ে দিন। গোলমাল না করলে আমরাও কিছু বলব না।’
বলাবাহুল্য, যার যা ছিল, চুড়ি, হার, আংটি, বোতাম, হাতঘড়ি, মনিব্যাগ— সব পাচার হয়ে গেল। তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে ভারীক্কে ভদ্রলোকের নতুন সুটকেসটিও তুলে নিয়ে তারাও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আরও কিছুক্ষণ পরে হট্টগোল শোনা গেল। ড্রাইভার, গার্ড, অন্যান্য যাত্রীরা নেমে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। আরও পরে গাড়ি আবার ছাড়ল। বড় স্টেশনে নাকি রেলের পুলিশের কাছে ডায়রি হবে। হারানো সম্পত্তির ফর্দ দিতে হবে।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই মোসায়েব বললেন, ‘আমাদের তো অল্পের ওপর দিয়ে গেল। বড় ক্ষতি হল আপনার।’ সবাই বলল, ‘কেন? কেন? কীসের বড় ক্ষতি?’ মোসায়েব বললেন, ‘ওই যে সুটকেসটি নিল, ওতে কর্তার মেয়ের বিয়ের দশ হাজার টাকার গয়না ছিল।— ও কী স্যার, মাথা নাড়ছেন কেন?’
কর্তা বললেন, ‘ছিল না!’
‘ছিল না? তবে গয়নাগুলো গেল কোথায়?’
বুড়ো আঙুল দিয়ে বাজার থলি দেখিয়ে কর্তা বললেন, ‘মূলোর মূলে?’ তাঁর বুদ্ধি দেখে সবাই হাঁ!
সুখের বিষয়, তিনদিন বাদে দলটি ধরা পড়ল, জিনিসপত্রও উদ্ধার হল। বউটি— যাকগে, এইসব কাঁচা মাল দিয়েই চোরের গল্প তৈরি হয়। বানাতে হয় না।
ছেলে মানুষ কর
দুনিয়াতে যতরকম শক্ত কাজ আছে, তার মধ্যে ছেলেপুলে মানুষ করা হল সব চাইতে বড়। তা সে পিটিয়ে সিধে করাই যাক, কিংবা আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তোলাই যাক। অনেক কাল আগে একটা বেশ মজার গল্প শুনেছিলাম। সুমতিদিদি ছিলেন একজন নামকরা শিক্ষাবিদ। তিনি গেছিলেন ইউরোপে আরও উচ্চশিক্ষা লাভ করতে। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হল ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তোলা। বলা বাহুল্য সুমতিদি চিরকুমারী।
সেদেশে একদিন ট্রেনের কামরায় আমার কামিনীদির সঙ্গে তাঁর দেখা হল। কামিনীদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল রত্ন এবং আরেকজন শিক্ষাবিদ। তাঁর সঙ্গে তাঁর ৪-৫ বছরের ছেলে। ছেলেটা সুমতিদিকে খালি খালি চিমটি কাটতে লাগল। সুমতিদি কামিনীদিদিকে বললেন, ‘আপনার ছেলেকে সামলান। আমাকে খালি খালি চিমটি কাটছে। ভারী দুষ্টু হয়েছে তো!’
কামিনীদিদি আহত হয়ে বললেন, ‘ছিঃ! অমন কড়া কথা বললে ওর কচি মনে দাগা লাগবে। সারা জীবন ও তার চিহ্ন বয়ে বেড়াবে।’
সুমতিদি বললেন, ‘তা হলে যেমন করে পারেন চিমটি কাটা বন্ধ করুন। আমার কচি মন নেই, তাতে দাগাও পড়ছে না। কিন্তু আধবুড়ো গায়ে কালসিটে পড়ছে।’
কামিনীদিদি ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘দেখছ বাবা, মাসিমার গায়ে কালসিটে পড়ে যাচ্ছে। ওঁকে চিমটি কাটছ কেন?’