হ্যারিসন রোড পাড়ার একটা গলিতে গোটা দুই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। বয়স কম, অবস্থা খুব সাধারণ। গলির ওপারে, বাড়ির মুখোমুখি আরেকটা ছোট বাড়িতে যোগীন্দ্রনাথ সরকার থাকতেন। তখন তাঁরও বয়স কম, অবস্থা সাধারণ, শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমন নাম-ডাক হয়নি।
দু’জনায় বেজায় ভাব। বাড়ি দুটিকে যদ্দূর মনে হয় মুখোমুখি না বলে পেছোপিছি বললে ঠিক হত। অর্থাৎ কিনা গলিতে সামনাসামনি দুই রান্নাঘর। কার বাড়িতে কী চড়েছে, অন্য বাড়ি থেকে সঙ্গে সঙ্গে জানা যেত। আর শুধু রান্নাঘরই বা কেন, এক বাড়ির কোনও কিছুই অন্য বাড়ির অজানা বা অদৃষ্ট থাকত না।
একদিন বিকেলে যোগীন সরকার বাড়ি ফিরছেন। গলিতে ঢুকেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালেন। গিরীশ শর্মার বড় মেয়ে শান্তির কোমরে দড়ি বেঁধে দোতলার জানলা থেকে ফুটপাথে নামানো হচ্ছে। বলাবাহুল্য নামাচ্ছেন গিরীশ শর্মা। বিকট চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে মেয়ে নিরাপদে ফুটপাথে পৌঁছলে পর, যোগীন সরকারের মুখে ভাষা ফিরে এল। রেগেমেগে বললেন, ‘এসব কী হচ্ছেটা কি? তোমার বাড়াবাড়ির দেখছি সীমা-পরিসীমা নেই।’
গিরীশ অম্লানবদনে বললেন, ‘ভয় ভাঙাচ্ছি। আমাকে বাধা দিয়ো না। পরে মধুপুরের বাড়ির কুয়োয় নামাব।’ সুখের বিষয়, আত্মীয়স্বজনের জ্বালায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
উপস্থিত বুদ্ধির জন্য বেশ নাম-ডাক ছিল তাঁর। একবার যোগীন সরকার এক সের মাংস কিনেছিলেন। দুই বাড়িতেই গিন্নিরা রাঁধতেন। যোগীন সরকারের স্ত্রী মাংস কুটে, ধুয়ে, নুন-হলুদ মাখিয়ে, ঢাকা দিয়ে একটু ভেতরের দিকে গেছেন। গিরীশ শর্মা সেই সুযোগে হাঁড়িসুদ্ধ কাঁচা মাংস তুলে এনে, গিন্নিকে বললেন, ‘এটা খুব ভাল করে রাঁধো তো দেখি।’
মেজদিদি চমৎকার রাঁধতেন। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে খুব ভাল করে মাংস বেঁধে, উনুনের পাশে ঢেকে রেখে, চান করতে গেলেন। অমনি যোগীন সরকার রান্না মাংসটি বাড়ি নিয়ে গেলেন। এর একটু বাদেই তাঁর বড় ছেলে গিরীশ শর্মাকে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। তাতে লেখা ছিল, ‘তোমরা বাড়িসুদ্ধ সকলে আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে খাবে। শুনলাম দুষ্কৃতকারীরা তোমাদের রান্নাঘরে হামলা দিয়েছে।’ তারপর মধুরেণ সমাপয়েৎ।
ক্রমে দু’বাড়ির ছেলেমেয়েরা বড় হল। যোগীন সরকাররা তখনও ওই বাড়িতেই থাকতেন কি না জানি না, তবে কাছাকাছিই থাকতেন। তাঁদের বাড়িতে কোনও ভাইঝি-টাইঝির বিয়ে। এবাড়িতে বিয়ে মানেই গিরীশ শর্মার বাড়িতেও বিয়ে। দু’জনে হরিহরাত্মা।
উদয়াস্ত খাটতে লাগলেন গিরীশ। উনুন কাটানো, ঠাকুর বহাল করা, ছানাপট্টি থেকে ছানা কেনা, ভিয়েন বসানো, ম্যারাপ বাঁধা, সওদা করা— এসব কাজ গিরীশ ছাড়া কে করবে? সেই হট্টগোলের মধ্যে গিরীশের বাড়ি গিয়ে যে তাঁদের নেমন্তন্ন করে আসা হয়নি, সেটা কেউই খেয়াল করেনি।
তাঁদের খেয়াল না থাকলেও, গিরীশের যথেষ্ট ছিল। ভোজের মেনু তাঁরই করা, কাজেই নিজের বাড়িতে অনিচ্ছুক গিন্নিকে দিয়ে সেইসমস্ত পদ রাঁধাতে কোনও অসুবিধা ছিল না। তারপর বিয়েবাড়ির লোক খাওয়ানো তদারক করার এক ফাঁকে বাড়ি গিয়ে, খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে, শান্তির হাতে দিয়ে, নিজের বগলে কুশাসন আর হাতে মাটির গেলাস নিয়ে, যেখানে শেষ ব্যাচের পাত পড়ছিল, তারি একধারে আসন দুটি পেতে দু’জনে বসে পড়ে, দুটি কলাপাতা চাইলেন।
কিছুক্ষণ তাঁর দেখা না পেয়ে সবাই ভাবছিল কোথায় গেলেন। পরিবেষ্টারা ছুটে আসতেই গিরীশ শর্মা বললেন, ‘উঁহুঁহুঁ! আমাদের খাবার আমরা এনেছি। আমরা তো আর নিমন্ত্রিত নই।’
সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থূল কাণ্ড। যোগীন সরকারের বড় বউদি টিফিন ক্যারিয়ার কেড়ে নিলেন। তারপর গিরীশের বাড়িতে নিজে গিয়ে সবাইকে ধরে নিয়ে এসে, পরিবেশন করে খাওয়ালেন।
এত রসই বা এখন কোথায়, এমন বন্ধুই বা কে পাচ্ছে?
চোর
ত্রিশ বছর আগে সম্পাদকমশাইরা গল্প চাইলেই আমি জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কীসের গল্প লিখব?’ তাঁরা বলতেন, ‘হয় প্রেমের, নয় ভূতের, নয় চোরের।’ কাজেই আমিও বুঝে নিলাম ওই তিনটিই হল ছোট গল্পের প্রধান উপজীব্য। তারপর অনেক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি ওই তিনটির মধ্যে আবার শেষেরটিই হল প্রধান, প্রথমটি নয়। এখন দেখছি চারদিকে ছড়িয়ে আছে চোরের গল্পের সামগ্রী। জ্যান্ত জ্যান্ত চোরের গল্প, বানাতেও হয় না।
কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনেই বেজায় চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। কেউ তার কোনও কিনারা করতে পারে না; একটা দুষ্কৃতকারীও ধরা পড়ে না। মাঝে মাঝে রাতে দলবল নিয়ে এসে জানলাটানলার শিক ভেঙে ঢুকে, বেবাক সামগ্রী পাচার করে দেয়। বাড়ির লোকে এমনি ঘুমোয় যে কিচ্ছু টের পায় না। কখনও কখনও গানের আসর, যাত্রা কিংবা নাটক-টাটক হলে, অনেকে বাড়ি বন্ধ করে, সদর দরজায় তালা দিয়ে, নিশ্চিন্ত মনে নাটক দেখে, বাড়ি ফিরে দেখে সব চাঁচাপোঁছা! কেউ ধরা পড়ে না।
এই সময় এক ছোকরা অধ্যাপক বিলেত থেকে সদ্য এসে কাজে যোগ দিলেন। সঙ্গে আনলেন খাসা ট্রানজিস্টর, রেকর্ড প্লেয়ার ইত্যাদির সঙ্গে চমৎকার এক হাত-ঘড়ি। ব্যাচেলর মানুষ, সংসারের ঝামেলা নেই। খালি বাড়ি ফেলে নাটক দেখে ফিরে এসে দেখে তালা যেমনকে তেমন ঝুলছে। কিন্তু ট্রানজিস্টর নেই, রেকর্ডপ্লেয়ার নেই আর সব চাইতে খারাপ হল যে হাতঘড়িটাও সেদিন ভদ্রলোক হাতে পরেননি, পাছে ভিড়ের মধ্যে হারায়। সেটিও নেই।