চন্ করে উঠল মাথা। বাধা দিয়ে বললুম, “কাজ চালাবার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা যাদের তারাই অন্যায়কারী, আর জগতে যারা কোনো কাজই করে না, করতে পারেও না, দয়ামায়া কেবল তাদেরই— এই সহজ অহংকারের মত্ততায় সত্যমিথ্যার প্রমাণ নিতেও মন চায় না।”
অচিরা বললে, “সত্য নয় বলতে চান? ”
আমি বললুম, “সত্য শব্দটা আপেক্ষিক। যা কিছু যত ভালোই হোক, তার চেয়ে আরো ভালো হতেও পারে। এই দেখুন-না আমার মোটা মাইনে বটে, তার থেকে মাকে পাঠাই পজ্ঞাশ, নিজে রাখি ত্রিশ, আর বাকি— সে হিসেবটা থাক্। কিন্তু মার জন্যে পনেরো নিজের জন্যে পাঁচ রাখলে আইডিয়ালের আরো কাছ ঘেঁষে যেত, কিন্তু একটা সীমা আছে তো।”
অচিরা বললে, “সীমাটা কি নিজের ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে।”
আমি বললুম, “না, অবস্থার উপরে। যে কথাটা উঠল সেটা একটু বিচার করে দেখুন। য়ুরোপে ইণ্ডস্ট্রীয়ালিজ্ম্ গড়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। যাদের হাতে টাকা ছিল এবং টাকা করবার প্রতিভা ছিল তারাই এটা গড়েছে। গড়েছে নিছক টাকার লোভে, সেটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু ঐ ঘুষটুকু যদি না পেত তা হলে একেবারে গড়াই হত না, এতদিন পরে আজ ওখানে পড়েছে হিসেবনিকেশের তলব।”
অচিরা বললে, “আপনি বলতে চান পায়ে তেল শুরুতে, কানমলা তার পরে? ”
“নিশ্চয়। আমাদের দেশে ভিত-গাঁথা সবে আরম্ভ হয়েছে এখনই যদি মার লাগাই তা হলে শুরুতেই হবে শেষ, সুবিধে হবে বিদেশী বণিকদের। মানছি আজ আমি লোভীদের ঘুষ দেওয়ার কাজ নিয়েছি, টাকাওয়ালার নায়েবি আমি করি। আজ সেলাম করছি বাদশার দরবারে এসে, কাল ওদের সিংহাসনের পায়ায় লাগাব কুড়ুল। ইতিহাসে তো এই দেখা গেছে।”
অচিরা বললে, “সব বুঝলুম। কিন্তু আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি দেখতে, এই স্ট্রাইক মেটাতে আপনি নিজে কবে যাবেন। নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকাও পড়েছিল। কিন্তু কেন যান নি? ”
চাপা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম, “এখানে কাজ ছিল বিস্তর।” কিন্তু ফাঁকি দেব কী করে। আমার ব্যবহারে তো আমার কৈফিয়তের প্রমাণ হয় না।
কঠিন হাসি হেসে দ্রুতপদে চলে গেল অচিরা।
আর চলবে না। একটা শেষ নিষ্পত্তি করাই চাই। নইলে অপমানের অন্ত থাকবে না।
সাঁওতালী পার্বণ শেষ হয়েছে। সকালে বেড়াতে বেরিয়েছি। অচিরা সঙ্গে ছিল। উত্তরের দিকে একটা পাহাড় উঠেছে, আকাশের নীলের চেয়ে ঘন নীল। তার গায়ে গায়ে চারা শাল আর বৃদ্ধ শাল গাছে বন অন্ধকার। মাঝখান দিয়ে কাঠুরেদের পায়ে-চলার পথ। অধ্যাপক একটা অর্কিড ফুল বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁর পকেটে সর্বদা থাকে আতস কাচ।
গাছগুলোর মধ্যে অন্ধকার যেখানে ভ্রূকুটিল হয়ে উঠেছে আর ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে তীব্র আওয়াজে, অচিরা বসল একটা শেওলাঢাকা পাথরের উপর। পাশে ছিল মোটা জাতের বাঁশগাছ, তারই ছাঁটা কঞ্চির উপর আমি বসলুম। আজ সকাল থেকে অচিরার মুখে বেশি কথা ছিল না। সেইজন্যেই তার সঙ্গে আমার কথা কওয়া বাধা পাচ্ছিল।
সামনের দিকে তাকিয়ে এক সময় সে আস্তে আস্তে বলে উঠল, “সমস্ত বনটা মিলে প্রকাণ্ড একটা বহুঅঙ্গওয়ালা প্রাণী। গুঁড়ি মেরে বসে আছে শিকারি জন্তুর মতো। যেন স্থলচর অক্টোপাশ, কালো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার নিরন্তর হিপনটিজমে ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে আমার মনের মধ্যে একটা ভয়ের বোঝা যেন নিরেট হয়ে উঠেছে।”
আমি বললুম, “কতকটা এইরকম কথাই এই সেদিন আমার ডায়ারিতে লিখেছি।”
অচিরা বলে চলল, “মনটা যেন পুরোনো ইমারত, সকল কাজের বার। নিষ্ঠুর অরণ্য যেখানে পেয়েছে তার ফাটল, চালিয়ে দিয়েছে শিকড়, সমস্ত ভিতরটাকে টানছে ভাঙনের দিকে। এই বোবা কালা মহাকায় জন্তু মনের ফাটল আবিষ্কার করতে মজবুত— আমার ভয় বেড়ে চলেছে। দাদু বলেছিলেন, ‘লোকালয় থেকে একান্ত দূরে থাকলে মানুষের মনঃপ্রকৃতি আসে অবশ হয়ে, প্রবল হয়ে ওঠে তার প্রাণপ্রকৃতি’। আমি জিগ্গেস করলুম, ‘এর প্রতিকার কী’। তিনি বললেন, ‘মানুষের মনের শক্তিকে আমরা সঙ্গে করে আনতে পারি, এই দেখো-না এনেছি তাকে আমার লাইব্রেরিতে।’ দাদুর উপযুক্ত এই উত্তর। কিন্তু আপনি কী বলেন।”
আমি বললুম, “আমাদের মন খোঁজে এমন একজন মানুষের সঙ্গ যে আমাদের সমস্ত অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে রাখতে পারে, চেতনার বন্যা বইয়ে দেয় জনশূন্যতার মধ্যে। এ তো লাইব্রেরির সাধ্য নয়।”
অচিরা একটু অবজ্ঞা করে বললে, “আপনি যার খোঁজ করছেন তেমন মানুষ পাওয়া যায় বৈকি, যদি বড্ড দরকার পড়ে। তারা চৈতন্যকে উসকিয়ে তোলে নিজের দিকেই, বন্যা বইয়ে দিয়ে সাধনার বাঁধ ভেঙে ফেলে। এ-সমস্তই কবিদের বানানো কথা, মোহরস দিয়ে জারানো। আপনাদের মতো বুকের-পাটাওয়ালা লোকের মুখে মানায় না। প্রথম যখন আপনাকে দেখেছিলুম, তখন দেখেছি আপনি রস খুঁজে বেড়ান নি, পথ খুঁড়ে বেড়িয়েছিলেন কড়া মাটি ভেঙে। দেখেছি আপনার নিরাসক্ত পৌরুষের মুর্তি— সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আপনাকে প্রণাম করেছি। আজ আপনি কথার পুতুল দিয়ে নিজেকে ভোলাতে বসেছেন। এ দশা ঘটালে কে। স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করি, এর কারণ কি আমি।”
আমি বললুম, “তা হতে পারে। কিন্তু আপনি তো সাধারণ মেয়ে নন। পুরুষকে আপনি শক্তি দেবেন।”
“হাঁ, শক্তি দেব, যদি নিজেকেই মোহ জড়িয়ে না ধরে। আভাসে বুঝেছি আপনি আমার ইতিহাস কিছু কিছু সংগ্রহ করেছেন। আপনার কাছে কিছু ঢাকবার দরকার নেই। আপনি শুনেছেন আমি ভবতোষকে ভালোবেসেছিলুম।”