এই গল্পের পক্ষে অধ্যাপকের ব্যাবহারিক নাম অনিলকুমার সরকার। তিনি গত জেনেরেশনের কেম্ব্রিজের বড়ো পদবীধারী। মাস আষ্টেক আগে কোনো কলেজের অধ্যক্ষপদ ত্যাগ করে এখানকার এস্টেটের একটা পোড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজের খরচে সেটা বাসযোগ্য করেছেন।
অন্তপর্ব
আমার গল্পের আদিপর্ব হল শেষ। ছোটো গল্পের আদি ও অন্তের মাঝখানে বিশেষ একটা ছেদ থাকে না— ওর আকৃতিটা গোল।
অচিরার সঙ্গে আমার অপরিচয়ের ব্যবধান ক্ষয় হয়ে আসছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন পরিচয়টাই ব্যবধান। কাছাকাছি আসছি বটে কিন্তু তাতে একটা প্রতিঘাত জাগছে। কেন? অচিরার প্রতি আমার ভালোবাসা ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে, অপরাধ কি তারই মধ্যে। কিংবা আমার দিকে ওর সৌহৃদ্য স্ফুটতর হয়ে উঠছে, সেইটেতেই ওর গ্লানি। কে জানে।
সেদিন চড়িভাতি তনিকা নদীর তীরে।
অচিরা ডাক দিলে, “ডাক্তার সেনগুপ্ত।”
আমি বললুম, “সেই প্রাণীটার কোনো ঠিকানা নেই, সুতরাং কোনো জবাব মিলবে না।”
“আচ্ছা, তা হলে নবীনবাবু।”
“সেও ভালো, যাকে বলে মন্দর ভালো।”
“কাণ্ডটা কী দেখলেন তো? ”
আমি বললুম, “আমার সামনে লক্ষ্য করবার বিষয় কেবল একটিমাত্রই ছিল, আর কিছুই ছিল না।”
এইটুকু ঠাট্টায় অচিরা সত্যই বিরক্ত হয়ে বললে, “আপনার আলাপ ক্রমেই যদি অমন ইশারাওয়ালা হয়ে উঠতে থাকে তা হলে ফিরিয়ে আনব ডাক্তার সেনগুপ্তকে, তাঁর স্বভাব ছিল গম্ভীর।”
আমি বললুম, “আচ্ছা তা হলে কাণ্ডটা কী হয়েছিল বলুন।”
“ঠাকুর যে ভাত রেঁধেছিল সে কড়্কড়ে, আদ্ধেক তার চাল। আমি বললুম, দাদু, এ তো তোমার চলবে না। দাদু অমনি ব’লে বসলেন, জান তো ভাই, খাবার জিনিস শক্ত হলে ভালো করে চিবোবার দরকার হয়, তাতেই হজমের সাহায্য করে। পাছে আমি দুঃখ করি দাদুর জেগে উঠল সায়েন্সের বিদ্যে। নিমকিতে নুনের বদলে যদি চিনি দিত তা হলে নিশ্চয় দাদু বলত, চিনিতে শরীরের এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।”
“দাদু, ও দাদু, তুমি ওখানে বসে বসে কী পড়ছ। আমি যে এদিকে তোমার চরিত্রে অতিশয়োক্তি- অলংকার আরোপ করছি, আর নবীনবাবু সমস্তই বেদবাক্য ব’লে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন।”
কিছু দূরে পোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির উপরে বসে অধ্যাপক বিলিতি ত্রৈমাসিক পড়ছিলেন। অচিরার ডাক শুনে সেখান থেকে উঠে আমাদের কাছে বসলেন। ছেলেমানুষের মতো হঠাৎ আমাকে জিগ্গেসা করলেন, “আচ্ছা নবীন, তোমার কি বিবাহ হয়েছে।”
কথাটা এতই সুস্পষ্ট ভাবব্যঞ্জক যে আর কেউ হলে বলত ‘না’, কিংবা ঘুরিয়ে বলত।
আমি আশাপ্রদ ভাষায় উত্তর দিলুম, “না, এখনো হয় নি।”
অচিরার কাছে কোনো কথা এড়ায় না। সে বললে, “ঐ এখনো শব্দটা সংশয়গ্রস্ত কন্যাকর্তাদের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, ওর কোনো যথার্থ অর্থ নেই।”
“একেবারেই নেই নিশ্চিত ঠাওরালেন কী করে।”
“ওটা গণিতের প্রব্লেম, সেও হাইয়ার ম্যাথ্ম্যাটিক্স্ নয়। পূর্বেই শোনা গেছে আপনি ছত্রিশ বছরের ছেলেমানুষ। হিসেব করে দেখলুম এর মধ্যে আপনার মা অন্তত পাঁচসাতবার বলেছেন, ‘বাবা ঘরে বউ আনতে চাই। ’ আপনি জবাব করেছেন, ‘তার পূর্বে ব্যাঙ্কে টাকা আনতে চাই।’ মা চোখের জল মুছে চুপ করে রইলেন, তার পরে মাঝখানে আপনার আর-সব ঘটেছিল কেবল ফাঁসি ছিল বাকি। শেষকালে এখানকার রাজসরকারের মোটা মাইনের কাজ জুটল। মা বললেন, ‘এইবার বউ নিয়ে এসো ঘরে। বড়ো কাজ পেয়েছে।’ আপনি বললেন, ‘বিয়ে করে সে কাজ মাটি করতে পারব না।’ আপনার ছত্রিশ বছরের গণিতফল গণনা করতে ভুল হয়েছে কি না বলুন।”
এ মেয়ের সঙ্গে অনবধানে কথা বলা নিরাপদ নয়। কিছুদিন আগেই আমার একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। কথায় কথায় অচিরা আমাকে বলেছিল, “আমাদের দেশের মেয়েরা আপনাদের সংসারের সঙ্গিনী হতে পারে কিন্তু বিলেতে যারা জ্ঞানের তাপস তাদের তপস্যার সঙ্গিনী তো জোটে, যেমন ছিলেন অধ্যাপক কুরির সধর্মিণী মাদাম কুরি। আপনার কি তেমন কেউ জোটে নি।”
মনে পড়ে গেল ক্যাথারিনকে। সে একইকালে আমার বিজ্ঞানের এবং জীবনযাত্রার সাহচর্য করতে চেয়েছিল।
অচিরা জিগ্গেসা করলে, “আপনি কেন তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন না।”
কী উত্তর দেব ভাবছিলুম, অচিরা বললে, “আমি জানি কেন। আপনার সত্যভঙ্গ হবে এই ভয় ছিল; নিজেকে আপনার মুক্ত রাখতেই হবে। আপনি যে সাধক। আপনি তাই নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর নিজের প্রতি, নিষ্ঠুর তার ’পরে যে আপনার পথের সামনে আসে। এই নিষ্ঠুরতায় আপনার বীরত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার সে বললে, “বাংলাসাহিত্য বোধ হয় আপনি পড়েন না। কচ ও দেবযানী ব’লে একটা কবিতা আছে। তার শেষ কথাটা এই, মেয়েদের ব্রত পুরুষকে বাঁধা, আর পুরুষের ব্রত মেয়ের বাঁধন কাটিয়ে স্বর্গলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আর আপনি মায়ের অনুনয়— একই কথা।”
আমি বললুম, “দেখুন, আমি হয়তো ভুল করেছিলুম। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের কাজ যদি না চলে তা হলে মেয়েদের সৃষ্টি কেন।”
অচিরা বললে, “বারো-আনার চলে, মেয়েরা তাদের জন্যেই। কিন্তু বাকি মাইনরিটি যারা সব-কিছু পেরিয়ে নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়েছে তাদের চলে না। সব-পেরোবার মানুষকে মেয়েরা যেন চোখের জল ফেলে রাস্তা ছেড়ে দেয়। যে দুর্গম পথে মেয়েপুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব সেখানে পুরুষেরা হোক জয়ী। যে মেয়েরা মেয়েলি, প্রকৃতির বিধানে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, তারা ছেলে মানুষ করে, সেবা করে ঘরের লোকের। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ, তাদের সংখ্যা খুব কম; তারা অভিব্যক্তির শেষ কোঠায়। মাথা তুলছে দুটি-একটি করে। মেয়েরা তাদের ভয় পায়, বুঝতে পারে না, টেনে আনতে চায় নিজের অধিকারের গণ্ডিতে । এই তত্ত্ব শুনেছি আমার দাদুর কাছে।”