“দাদু, বিশ্বাস কোরো না এ-সব লোককে। তুমি বাংলা-মাসিকে লিখেছিলে বাঙালির খাদ্যে ভিটেমিনের প্রভাব,সে উনি পড়েছেন, তাই কেবল তোমাকে খুশি করবার জন্যে চিঁড়েকলার ফর্দ তোমাকে শোনালেন।”
আমি ভাবলুম, মুশকিলে ফেললে। বাংলা কাগজে ডাক্তারের লেখা ভিটামিনের তত্ত্ব পড়া কোনোকালে আমার দ্বারা সম্ভব নয়; কিন্তু কবুল করি কী করে।— বিশেষত উনি যখন উৎফুল্ল হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সেটা পড়েছেন নাকি।”
আমি বললুম, “পড়ি বা না-পড়ি তাতে কিছু আসে যায় না, আসল কথা—”
“আসল কথা, উনি নিশ্চয়ই জানেন কাল যদি ওঁকে খাওয়াই, তা হলে ওঁর পাতে পশুপক্ষী স্থাবরজঙ্গম কিছুই বাদ পড়বে না। সেইজন্যে, অত নিশ্চিন্ত মনে বিলিতি বেগুনের নামকীর্তন করলেন। ওঁর শরীরটার দিকে দেখো-না চেয়ে, শুধু শাকান্নে গড়া ব’লে কেউ সন্দেহ করতে পারে? দাদু, “তুমি সবাইকেই অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস কর, এমন-কি, আমাকেও। সেইজন্যে ঠাট্টা করে তোমাকে কিছু বলতে সাহস করি নে।”
বলতে বলতে ধীরে ধীরে আমরা ওঁদের বাড়ির দিকে চলেছি, এমন সময় হঠাৎ অচিরা বলে উঠল, “এইবার আপনি ফিরে যান বাসায়।”
“কেন, আমি ভেবেছিলুম আপনাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।”
“ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। আপনি বলবেন, বাঙালি মেয়েরা সব অগোছালো। কাল এমন ক’রে সাজিয়ে রাখব যে মেমসাহেবের কথা মনে পড়বে।”
অধ্যাপক বললেন, “আপনি কিছু মনে করবেন না ডক্টর সেনগুপ্ত, অচি বেশি কথা কচ্ছে, কিন্তু ওর স্বভাব নয় সেটা। এখানে বড়ো নির্জন ব’লে ও জুড়ে রাখে আমার মনকে অনর্গল কথা কয়ে। সেটাই ওর অভ্যেস হয়ে গেছে। ও যখন চুপ করে থাকে তখনই আমার ঘরটা যেন ছম্ছম্ করতে থাকে, আমার মনটাও। ও জানে সে কথা। আমার ভয় করে পাছে ওকে কেউ ভুল বোঝে।”
বুড়োর গলা জড়িয়ে ধ’রে অচিরা বললে, “বুঝুক-না দাদু, অত্যন্ত অনিন্দনীয়া হতে চাই নে, সেটা অত্যন্ত আন-ইন্টারেস্টিঙ।”
অধ্যাপক সগর্বে বলে উঠলেন, “জানেন সেনগুপ্ত, আমার দিদি কিন্তু কথা কইতে জানে, অমন আমি কাউকে দেখি নি।”
“তুমি আমার মতো কাউকে দেখো নি দাদু, আমিও কাউকে দেখি নি তোমার মতো।”
আমি বললুম, “আচার্যদেব, যাবার আগে আমাকে কিন্তু একটা কথা দিতে হবে।”
“আচ্ছা বেশ।”
“আপনি যতবার আমাকে আপনি বলেন, আমি মনে-মনে ততবার জিভ কাটতে থাকি। আমাকে তুমি যদি বলেন, তা হলে সেটাতেই যথার্থ আপনার স্নেহে সম্মান পাব। এ বাড়িতে আমাকে তুমি-শ্রেণীতে তুলে দিতে আপনার নাতনিও সাহায্য করবেন।”
“সর্বনাশ! আমি সামান্য নাতনি, হঠাৎ অত উঁচুতে নাগাল পাব না, আপনি বড়োলোক। আমি বলি আর-কিছুদিন যাক, যদি ভুলতে পারি আপনার ডিগ্রিধারী রূপ, তা হলে সবই সম্ভব হবে। কিন্তু দাদুর কথা স্বতন্ত্র। এখনই শুরু করো। দাদু, বলো তো, তুমি কাল খেতে এসো, দিদি যদি মাছের ঝোলে নুন বেশি দিয়ে ফেলে, তা হলে ভালোমানুষের মতো সহ্য কোরো, বোলো, বাঃ কী চমৎকার, পাতে আরো একটু দিতে হবে।”
অধ্যাপক সস্নেহে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই, আর কিছুকাল আগে যদি আমার দিদিকে দেখতে, তা হলে বুঝতে পারতে, আসলে ও লাজুক। সেইজন্যে ও যখন আলাপ করা কর্তব্য মনে করে, তখন জোর করতে গিয়ে কথা বেশি হয়ে পড়ে।”
“দেখেছেন ডক্টর সেনগুপ্ত, দাদু আমাকে কী রকম মধুর ক’রে শাসন করেন। যেন ইক্ষুদণ্ড দিয়ে। অনায়াসে বলতে পারতেন, তুমি বড়ো মুখরা, তোমার প্রগল্ভতা অত্যন্ত অসহ্য। আপনি কিন্তু আমাকে ডিফেণ্ড করবেন। কী বলবেন, বলুন-না।”
“আপনার মুখের সামনে বলব না।”
“বেশি কঠোর হবে? ”
“আপনি জানেন আমার মনের কথা।”
“তা হলে থাক্। এখন বাড়ি যান।”
“একটা কথা বাকি আছে। কাল আপনাদের ওখানে যে নেমন্তন্ন সে আমার নতুন নামকরণের। কাল থেকে নবীনমাধব নাম থেকে লোপ পাবে ডাক্তার সেনগুপ্ত। সূর্যের কাছে আনাগোনা করতে গিয়ে ধূমকেতুর যেমন লেজটা যায় উড়ে, মুণ্ডটা থাকে বাকি।”
“তা হলে নামকর্তন বলুন, নামকরণ বলছেন কেন।”
“আচ্ছা, তাই সই।”
এইখানে শেষ হল আমার প্রথম বড়োদিন।
বার্ধক্যের কী প্রশান্ত সৌন্দর্য, কী সৌম্য মূর্তি। চোখদুটি যেন আশীর্বাদ করছে। হাতে একটি পালিশ-করা লাঠি, গলায় শুভ্র পাট-করা চাদর, ধুতি যত্নে কোঁচানো, গায়ে তসরের জামা, মাথায় শুভ্র চুল বিরল হয়ে এসেছে, কিন্তু পরিপাটি করে আঁচড়ানো। স্পষ্ট বোঝা যায় এর সাজসজ্জায় এর দিনযাত্রায় নাতনির হাতের শিল্পকার্য। ইনি যে অতিলালনের অত্যাচার সহ্য করেন, সে কেবল এই মেয়েটিকে খুশি রাখবার জন্যে।
আমার বৈজ্ঞানিক খবরকে ছাড়িয়ে উঠল, এঁদের খবর নেওয়া। অধ্যাপকের নাম ব্যবহার করব, অনিলকুমার সরকার। গত জেনেরেশনের কেম্ব্রিজ য়ুনিভারসিটির পি.এইচ.ডি. দলের একজন। মাসকয়েক আগে একটি ঔপনাগরিক কলেজের অধ্যক্ষতা ত্যাগ করে এখানকার স্টেটের একটা পরিত্যক্ত ডাকবাংলা ভাড়া নিয়ে নিজের খরচে সেটা বাসযোগ্য করেছেন। এইটে হল ইতিহাসের খসড়া, বাকিটুকু বঙ্কিমের চিঠি থেকে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
আমার গল্পের আদিপর্ব শেষ হয়ে গেল। ছোটোগল্পের আদি ও অন্তে বেশি ব্যবধান থাকে না। জিনিসটাকে ফলিয়ে বলবার লোভ করব না, ওর স্বভাব নষ্ট করতে চাই নে।
অচিরার সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার যুগ এল সংক্ষেপেই। সেদিন চড়িভাতি হয়েছিল তনিকা নদীর তীরে।