“সত্যি কথাই বলি তবে, বী, যাকে বলে thirll, যাকে বলে ecstasy, সে হল পয়লা নম্বরের জিনিস, ভাগ্যে দৈবাৎ মেলে। কিন্তু তুমি যাকে বলছ ভিড়ের মধ্যে টানাটানি, সে হল সেকেণ্ডহ্যাণ্ড দোকানের মাল, কোথাও বা দাগী, কোথাও বা ছেঁড়া, কিন্তু বাজারে সেও বিকোয়, অল্প দামে। সেরা জিনিসের পুরো দাম দিতে পারে ক’জন ধনী।”
“তুমি পার অভী, নিশ্চয় পার, পুরো মূল্য আছে তোমার হাতে। কিন্তু অদ্ভুত তোমার স্বভাব, ছেঁড়া জিনিসে, ময়লা জিনিসে তোমাদের আর্টিস্টের একটা কৌতুক আছে, কৌতূহল আছে। সুসম্পূর্ণ জিনিস তোমাদের কাছে picturesque। থাক্ গে এ-সব বৃথা তর্ক। আপাতত ক্রাইসলারের পালাটা যতদূর সম্ভব এগিয়ে দেওয়া যাক।”
এই ব’লে চৌকি ছেড়ে বিভা পাশের ঘরে চলে গেল। ফিরে এসে অভীকের হাতে একতাড়া নোট দিয়ে বললে, “এই নাও তোমার ইন্স্পিরেশন, কোম্পানিবাহাদুরের মার্কামারা। কিন্তু তাই ব’লে তোমার ঐ ঘড়ি আমাকে নিতে বোলো না।”
চৌকিতে মাথা রেখে অভীক মেঝের উপরে বসে রইল। বিভা দ্রুত পদে তার হাত টেনে নিয়ে বললে, “আমাকে ভুল বুঝো না। তোমার অভাব ঘটেছে। আমার অভাব নেই এমন সুযোগে—”
বিভাকে থামিয়ে দিয়ে অভীক বললে, “অভাব আছে আমার, দারুণ অভাব। তোমার হাতেই রয়েছে সুযোগ,তা পূরণ করবার। কী হবে টাকায়।”
বিভা অভীকের হাতের উপরে স্নিগ্ধভাবে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, “যা পারি নে তার দুঃখ রইল আমার মনে চিরদিন। যতটুকু পারি তার সুখ থেকে কেন আমাকে বঞ্চিত করবে।”
“না না না, কিছুতেই না। তোমারই কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে শীলাকে আমি গাড়ি চড়িয়ে বেড়াব? এ প্রস্তাবে ধিক্কার দেবে এই ভেবেছিলুম, রাগ করবে এই ছিল আশা।”
“রাগ করব কেন। তোমার দুষ্টুমি কতক্ষণের। এটা সাংঘাতিক শীলার পক্ষে, তোমার পক্ষে একটুও না। এমন ছেলেমানুষি কতবার তোমার দেখেছি, মনে মনে হেসেছি। জানি কিছুদিনের মতো এ খেলা না হলে তোমার চলে না। এও জানি স্থায়ী হলে আরো অচল হয়। হয়তো তুমি কিছু পেতে চাও, কিন্তু তোমাকে কিছু পাবে এ সইতে পার না।”
“বী, আমাকে তুমি অত্যন্ত বেশি জান তাই এমন ঘোরতর নিশ্চিন্ত থাক। জানতে পেরেছ আমার ভালো লাগে মেয়েদের কিন্তু সে ভালো-লাগা নাস্তিকেরই, তাতে বাঁধন নেই। পাথরে-গাঁথা মন্দিরে সে পূজাকে বন্দী করব না। বান্ধবীদের সঙ্গে গলাগলির গদ্গদ্ দৃশ্য মাঝে মাঝে দেখেছি, সেই বিহ্বল স্ত্রৈণতায় আমার গা কেমন করে। কিন্তু মেয়েরা আমার কাছে নাস্তিকের দেবতা, অর্থাৎ আর্টিস্টের। আর্টিস্ট খাবি খেয়ে মরে না, সে সাঁতার দেয়, দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যায়। আমি লোভী নই, আমাকে নিয়ে যে মেয়ে ঈর্ষা করে সে লোভী। তুমি লোভী নও, তোমার নিরাসক্ত মনের সব চেয়ে বড়ো দান স্বাধীনতা।”
বিভা হেসে বললে, “তোমার স্তব এখন রাখো। আর্টিস্ট, তোমরা সাবালক শিশু, এবার যে খেলাটা ফেঁদেছ তার খেলনাটি না-হয় আমার হাত থেকেই নেবে।”
“নৈব নৈব চ। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। তোমার ট্রাস্টিদের মুঠো থেকে এ টাকা খসিয়ে নিলে কী করে।”
“খোলসা করে বললে হয়তো খুশি হবে না। তুমি জান অমরবাবুর কাছে আমি ম্যাথাম্যাটিক্স্ শিখছি.।”
“সব-তাতেই আমাকে বহু দূরে এড়িয়ে যেতে চাও, বিদ্যেতেও? ”
“বোকো না, শোনো। আমার ট্রাস্টীদের মধ্যে একজন আছেন আদিত্যমামা। নিজে তিনি গণিতে ফর্স্টক্লাস মেডালিস্ট। তাঁর বিশ্বাস, যথেষ্ট সুযোগ পেলে অমরবাবু দ্বিতীয় রামানুজম্ হবেন। ওঁর কষা একটুখানি প্রব্লেম আইনস্টাইনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যা উত্তর পেয়েছিলেন সেটা আমি দেখেছি। এমন লোককে সাহায্য করতে হলে তাঁর মান বাঁচিয়ে করতে হয়। আমি তাই বললুম,ওঁর কাছে গণিত শিখব। মামা খুব খুশি। শিক্ষাখাতে ট্রাস্টফাণ্ড থেকে কিছু থোক টাকা আমার হাতে রেখে দিয়েছেন। তারই থেকে আমি ওঁকে বৃত্তি দিই।”
অভীকের মুখ কেমন একরকম হয়ে গেল। একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে, “এমন আর্টিস্টও হয়তো আছে যে উপযুক্ত সুযোগ পেলে মিকেল আঞ্জেলোর অন্তত দাড়ির কাছটাতে পৌঁছতে পারত।”
“কোনো সুযোগ না পেলেও হয়তো পারবে পৌঁছতে। এখনো বলো আমার কাছ থেকে টাকাটা নেবে কি না।”
“খেলনার দাম? ”
“হাঁ গো, আমরা তো চিরকাল তোমাদের খেলনার দামই দিয়ে থাকি। তাতে দোষ কী। তার পরে আছে আঁস্তাকুড়।”
“ক্রাইসলারের আজ শ্রাদ্ধশ্রান্তি হল এইখানেই। প্রগতিশীলার প্রগতিবেগ ভাঙা ফোর্ডেই নড়্নড়্ করতে করতে চলুক। এখন ও-সব কথা আর ভালো লাগছে না। অমরবাবু শুনেছি টাকা জমাচ্ছেন বিলেতে যাবার জন্যে, সেখান থেকে প্রমাণ করে আসবেন তিনি সামান্য লোক নন।”
বিভা বললে, “একান্ত আশা করি, তাই যেন ঘটে। তাতে দেশের গৌরব।”
উচ্চকণ্ঠে বললে অভীক, “আমাকেও তাই প্রমাণ করতে হবে, তুমি আশা কর আর নাই কর। ওঁর প্রমাণ সহজ, লজিকের বাঁধা রাস্তায়, আর্টের প্রমাণ রুচির পথে, সে রসিক লোকের প্রাইভেট পথ। সে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড নয়। আমাদের এই চোখে-ঠুলি-পরা ঘানি-ঘোরানোর দেশে আমার চলবে না। যাদের দেখবার স্বাধীন দৃষ্টি আছে,আমি যাবই তাদের দেশে। একদিন তোমার মামাকে যেন বলতে হয়, আমিও সামান্য লোক নই, আর তার ভাগনীকেও —”
“ভাগনীর কথা বোলো না। তুমি মিকেল আঞ্জেলোর সমান মাপের কি না তা জানবার জন্যে তাকে সবুর করতে হয় নি। তার কাছে তুমি বিনা প্রমাণেই অসামান্য। এখন বলো, তুমি যেতে চাও বিলেতে? ”