“হাঁ শুনেছি।”
“এও জানেন আমার ভালোবাসার অপমান ঘটেছে।”
“হাঁ জানি।”
“সেই অপমানিত ভালোবাসা অনেকদিন ধরে আমাকে আঁকড়ে ধরে দুর্বল করেছে। আমি জেদ করে বসেছিলুম তারই একনিষ্ঠ স্মৃতিকে জীবনের পূজামন্দিরে বসাব। চিরদিন একমনে সেই নিষ্ফল সাধনা করব মেয়েরা যাকে বলে সতীত্ব। নিজের ভালোবাসার অহংকারে সংসারকে ঠেলে ফেলে নির্জনে চলে এসেছি। কর্তব্যকে অবজ্ঞা করেছি নিজের দুঃখকে সম্মান করব ব’লে। আমার দাদুকে অনায়াসে সরিয়ে এনেছি তাঁর কাজের ক্ষেত্র থেকে। যেন এই মেয়েটার হৃদয়ের অহমিকা পৃথিবীর সব-কিছুর উপরে। মোহ, মোহ, অন্ধ মোহ।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ সে বলে উঠল, “জানেন আপনিই সেই মোহ ভাঙিয়ে দিয়েছেন।”
বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। সে বললে, “আপনিই এই আত্মাবমাননা থেকে ছিনিয়ে এনে আমাকে বাঁচালেন।”
স্তব্ধ রইলুম নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে।
“আপনি তখনো আমাকে দেখেন নি। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখেছি আপনার দুঃসাধ্য প্রয়াসের দিনগুলি— সঙ্গ নেই, আরাম নেই, ক্লান্তি নেই, একটু কোথাও ছিদ্র নেই অধ্যবসায়ে। দেখেছি আপনার প্রশস্ত ললাট, আপনার চাপা ঠোঁটে অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তির লক্ষণ, আর দেখেছি মানুষকে কী রকম অনায়াসে প্রভুত্বের জোরে চালনা করেন। দাদুর কাছে আমি মানুষ, আমি পুরুষের ভক্ত, যে পুরুষ সত্য যে পুরুষ তপস্বী। সেই পুরুষকেই দেখবার জন্যে আমার ভক্তিপিপাসু নারী ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করে ছিল নিজের অগোচরে। মাঝখানে এসেছিল অপদেবতা প্রবৃত্তির টানে। অবশেষে নিষ্কাম পুরুষের সুদৃঢ় শক্তিরূপ আপনিই আনলেন আমার চোখের সামনে।
আমি জিগ্গেসা করলুম, “তার পর কি ভাবের পরিবর্তন হয়েছে।”
“হাঁ হয়েছে। আপনার বেদী থেকে নেমে এসেছেন প্রতিদিন। স্থানীয় কাগজে পড়লুম, দূরে অন্য-এক জায়গায় সন্ধানের কাজে আপনার ডাক পড়েছে। আপনি নড়লেন না, ভিতরে ভিতরে আত্মগ্লানি ভোগ করলেন। আপনার পথের সামনেকার ঢেলাখানার মতো আমাকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন না কেন। কেন নিষ্ঠুর হতে পারলেন না। যদি পারতেন তবে আমি ধন্য হতুম। আমার ব্রতের পারণা হত আমার কান্না দিয়ে।”
মৃদুস্বরে বললুম, “যাবার জন্যেই কাগজপত্তর গুছিয়ে নিচ্ছিলুম।”
“না, না, কখনোই না। মিথ্যে ছুতো করে নিজেকে ভোলাচ্ছিলেন। যতই দেখলুম আপনার দুর্বলতা, ভয় হতে লাগল আমার নিজেকে নিয়ে। ছি, ছি, কী পরাভবের বিষ এনেছি নারীর জীবনে, কেবল অন্যের জন্যে নয়, নিজের জন্যেও। ক্রমশই একটা চাঞ্চল্য আমাকে পেয়ে বসল, সে যেন এই বনের বিষনিশ্বাস থেকে । একদিন এখানকার পিশাচী রাত্রি এমন আমাকে আবিষ্ট করে ধরেছিল যে মনে হল যে এত বড়ো প্রবৃত্তি রাক্ষসীও আছে যে আমার দাদুর কাছ থেকেও আমাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। তখনই সেই রাত্রেই ছুটে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ডুব দিয়ে দিয়ে স্নান করে এসেছি।”
এই কথা বলতে বলতে অচিরা ডাক দিল, “দাদু।”
অধ্যাপক গাছতলায় বসে পড়ছিলেন। উঠে এসে স্নেহের স্বরে বললেন, “কী দিদি? দূর থেকে বসে বসে ভাবছিলুম, তোমার উপরে আজ বাণী ভর দিয়েছেন— জ্বল জ্বল করছে তোমার চোখ দুটি।”
“আমার কথা থাক্, তুমি শোনো। তুমি সেদিন বলেছিলে মানুষের চরম অভিব্যক্তি তপস্যার মধ্য দিয়ে।”
“হাঁ, আমি তাই তো বলি। বর্বর মানুষ জন্তুর পর্যায়ে। কেবলমাত্র তপস্যার মধ্য দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ। আরো তপস্যা আছে সামনে, স্থূল আবরণ যুগে যুগে ত্যাগ করতে করতে সে হবে দেবতা। পুরাণে দেবতার কল্পনা আছে, কিন্তু দেবতা ছিলেন না অতীতে, দেবতা আছেন ভবিষ্যতে। মানুষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে।”
অচিরা বললে, “দাদু, এইবার এসো, তোমার-আমার কথাটা আপসে চুকিয়ে দিই, কদিন থেকে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে।”
আমি উঠে পড়লুম, বললুম, “তা হলে যাই।”
“না, আপনি বসুন।— দাদু, সেই যে কলেজের অধ্যক্ষপদটা তোমার ছিল, সেটা খালি হয়েছে। তোমাকে ডাক দিয়েছে ওরা।”
অধ্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কী করে জানলে ভাই।”
“তোমার কাছে চিঠি এসেছে, সে আমি চুরি করেছি।”
“চুরি করেছ! ”
“করব না! আমাকে সব চিঠিই দেখাও কেবল কলেজের ছাপ-মারা ঐ চিঠিটাই দেখালে না। তোমার দুরভিসন্ধি সন্দেহ করে চুরি করে দেখতে হল।”
অধ্যাপক অপরাধীর মতো ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমারই অন্যায় হয়েছে।”
“কিছু অন্যায় হয় নি। আমাকে লুকোতে চেয়েছিলে যে আমার জীবনের অভিসম্পাত এখনো তুমি নিজের উপর টেনে নিয়ে চলবে। তোমার আপন আসন থেকে আমি যে নামিয়ে এনেছি তোমাকে। আমাদের তো ঐ কাজ।”
“কী বলছ দিদি।”
“সত্যি কথাই বলছি। তুমি শিক্ষাদানযজ্ঞের হোতা, এখানে এনে আমি তোমাকে করেছি শুধু গ্রন্থকীট। বিশ্বসৃষ্টি বাদ দিলে কী দশা হয় বিশ্বকর্তার। ছাত্র না থাকলে তোমার হয় ঠিক তেমনি। সত্যি কথা বলো।”
“বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করে এসেছি কিনা।”
“তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! কী যে বল তুমি! তুমি যে স্বভাবতই আচার্য। দেখেন নি, নবীনবাবু, ওঁর মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে কি আর দয়ামায়া থাকে না। অমনি আমাকে নিয়ে পড়েন— বারো-আনাই বুঝতেই পারি না। নইলে হাতড়িয়ে বের করেন এই নবীনবাবুকে, সে হয় আরো শোচনীয়। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই জানি, কিন্তু বাছাই করে নিয়ো, রূপকথার রাজা সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার মুখ দেখত তাকেই কন্যা দান করত। তোমার বিদ্যাদান অনেকটা সেই রকম।”