এই পর্যন্ত বলে বাচস্পতি মশায় একবার সভাস্থ সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন।
বললেন, দেখুন একবার, সহজ কাকে বলে। অভিধানের প্রয়োজনই হয় না।
সভার লোকেরা বললে, প্রয়োজন হলেই বা পাব কোথায়।
বাচস্পতি মশায় একটু চোখ টিপে বললেন, ভাবখানা বুঝেছেন তো?
মথুরবাবু বললেন, বুঝেছি বৈকি। সমুদ্রগুপ্ত অজাতশত্রুকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিয়েছিলেন। আহা, বাচস্পতি মশায়, লোকটাকে একেবারে সমুসদ্গারিত করে দিলে গো— একেবারে পরমন্তি শয়নে।
বাচস্পতি বললেন, ছোটোলাট একবার এসেছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলে বুটের ধুলো দিয়ে যেতে। তখন আমি তাঁকে এই বুগবুলবুলি ভাষার একটা ইংরেজি তর্জমা শুনিয়েছিলুম।
সভাস্থ সকলেই বললেন, ইংরেজিটা শোনা যাক।
বাচস্পতি পড়ে গেলেন, দি হাব্বারফ্লুয়াস ইন্ফ্যাচুফুয়েশন অব আকবর ডর্বেণ্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজট্ দি গর্ব্যাণ্ডিজম্ অফ হুমায়ুন। শুনে ছোটোলাট একেবারে টরেটম্ বনে গিয়েছিলেন; মুখ হয়েছিল চাপা হাসিতে ফুস্কায়িত। হেড পেডেণ্ডোর টিকির চার ধারে ভেরেণ্ডম্ লেগে গেল, সেক্রেটারি চৌকি থেকে তড়তং করে উৎখিয়ে উঠলেন। ছেলেগুলোর উজবুন্মুখো ফুড়ফুড়োমি দেখে মনে হল, তারা যেন সব ফিরিচুঞ্চুসের একেবারে চিক্চাকস্ আমদানি। গতিক দেখে আমি চংচটকা দিলুম।
সভাপতি বললেন, বাচস্পতি, এইখানেই ক্ষান্ত দাও হে, আর বেশিক্ষণ চললে পরাগগলিত হয়ে যাব। এখনি মাথাটার মধ্যে তাজ্ঝিম্ মাজ্ঝিম্ করছে।
বাচস্পতি আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে সভাপতির ভাষা এতদিনে ওঁদের মুখবুদ্বুদী শব্দে রঝম্ গঝম্ করে উঠত।
*
* *
যার যত নাম আছে সব গড়া পেটা,
যে নাম সহজে আসে দেওয়া যাক সেটা—
এই বলে কাউকে সে ডাকে বুজ্কুল,
আদ্রুম ডাকত সে যে ছিল অতুল।
মোতিরাম দাস নিল নাম মুচকুস,
কাশিরাম মিত্তির হল পুচফুস।
পাঁশগাড়ি নাম নিল পাঁচকড়ি ঘোষ,
আজ হতে বাজ্রাই হল আশুতোষ।
ভুষকুড়ি রায় হল শ্রীমজুমদার,
কুর্দম হয়ে গেল যে ছিল কেদার।
যেদিন যূথীরে নাম দিল ভুজকুশি,
সেদিন স্বামীর সাথে হল ঘুষোঘুষি।
পিচকিনি নাম দিল যবে ললিতারে
দাদা এসে রাসকেল বলে গেল তারে।
মিঠে মিঠে নাম যত মানে দিয়ে ঘেরা,
সে বলত, ভাবীকালে রবে না তো এরা—
পিত্ত নাশিবে নাম যদি হয় তিতো,
ভুজকালি নাম দেখো আমি নিয়েছি তো।
পাড়ার লোকেরা বলে ঘিরে তার বাড়ি,
ভাবীকালে পৌঁছিয়ে দিব তবে গাড়ি।
বেচারা গতিক দেখে দিল মুখ ঢাকা,
পিছে পিছে তাড়া করে মেসো আর কাকা।
দিয়েছিল যে মেয়ের নাম উজকুড়ি,
সঙ্গে উকিল নিয়ে এল তার খুড়ি।
শুনলে সে কেস্ হবে ডিফামেশনের,
ছেড়ে দিলে কাজ নাম-পরিবেশনের।
বিজ্ঞানী
দাদামশায়, নীলমণিবাবুকে তোমার এত কেন ভালো লাগে আমি তো বুঝতে পারি নে।
এই প্রশ্নটা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত প্রশ্ন, এর ঠিক উত্তর ক’জন লোকে দিতে পারে।
তোমার হেঁয়ালি রাখো। অমন এলোমেলো আলুথালু অগোছালো লোককে মেয়েরা দেখতে পারে না।
ওটা তো হল সার্টিফিকেট, অর্থাৎ লোকটা খাঁটি পুরুষমানুষ।
জান না তুমি, উনি কথায় কথায় কী রকম হুলুস্থূল বাধিয়ে তোলেন। হাতের কাছে যেটা আছে সেটা ওঁর হাতেই ঠেকে না। সেটা উনি খুঁজে বেড়ান পাড়ায় পাড়ায়।
ভক্তি হচ্ছে তো লোকটার উপরে।
কেন শুনি।
হাতের কাছের জিনিসটাই যে সবচেয়ে দূরের সে ক’জন লোক জানে, অথচ নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে।
একটা দৃষ্টান্ত দেখাও দেখি।
যেমন তুমি।
আমাকে তুমি খুঁজে পাও নি বুঝি?
খুঁজে পেলে যে রস মারা যেত, যত খুঁজছি তত অবাক হচ্ছি।
আবার তোমার হেঁয়ালি।
উপায় নেই। দিদি, আমার কাছে আজও তুমি সহজ নও, নিত্যি নূতন।
কুসমি দাদামশায়ের গলা জড়িয়ে বললে, দাদামশায় এটা কিন্তু শোনাচ্ছে ভালো। কিন্তু, ও কথা থাক্। নীলুবাবুর বাড়িতে কাল কী রকম হুলুস্থূল বেধেছিল সে খবরটা বিধুমামার কাছে শোনো-না।
কী গো মামা, কী হয়েছিল শুনি।
অদ্ভুত— বিধুমামা বললেন, পাড়ায় রব উঠল নীলুবাবুর কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না; খোঁজ পড়ে গেল মশারির চালে পর্যন্ত। ডেকে পাঠালে পাড়ার মাধুবাবুকে।
বললে, ওহে মাধু, আমার কলমটা?
মাধুবাবু বললেন, জানলে খবর দিতুম।
ধোবাকে ডাক পড়ল, ডাক পড়ল হারু নাপিতকে। বাড়িসুদ্ধ সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন তার ভাগ্নে এসে বললে, কলম যে তোমার কানেই আছে গোঁজা।
যখন কোনো সন্দেহ রইল না তখন ভাগ্নের গালে এক চড় মেরে বললে, বোকা কোথাকার, যে কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না সেটাই খুঁজছি।
রান্নাঘর থেকে স্ত্রী এল বেরিয়ে; বললে, বাড়ি মাথায় করেছ যে।
নীলু বললে, যে কলমটা চাই ঠিক সেই কলমটা খুঁজে পাচ্ছি না।
বউদি বললে, যেটা পেয়েছ সেই দিয়েই কাজ চালিয়ে নেও, যেটা পাও নি সেটা কোথাও পাবে না।
নীলু বললে, অন্তত সেটা পাওয়া যেতে পারে কুণ্ডুদের দোকানে।
বউদি বললে, না গো, দোকানে সে মাল মেলে না।
নীলু বললে, তা হলে সেটা চুরি গিয়েছে।
তোমার সব জিনিসই তো চুরি গিয়েছে, যখন চোখে পাও না দেখতে। এখন চুপচাপ করে এই কলম নিয়েই লেখো, আমাকেও কাজ করতে দাও। পাড়াসুদ্ধ অস্থির করে তুলেছ।
সামান্য একটা কলম পাব না কেন শুনি।
বিনি পয়সায় মেলে না বলে।
দেব টাকা — ওরে ভুতো।
আজ্ঞে—
টাকার থলিটা যে খুঁজে পাচ্ছি না।
ভুতো বললে, সেটা যে ছিল আপনার জামার পকেটে।
তাই নাকি।