জিগ্গেস করেছি ইরুকে, রাজবাড়িটা কোথায় বলো-না।
সে চোখ দুটো এতখানি করে বলত, এই বাড়িতেই।
আমি তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতুম হাঁ করে; বলতুম, এই বাড়িতেই— কোন্খানে আমাকে দেখিয়ে দাও-না।
সে বলত, মন্তর না জানলে দেখবে কী করে।
আমি বলতুম, মন্তর আমাকে বলে দাও-না। আমি তোমাকে আমার কাঁচাআম-কাটা ঝিনুকটা দেব।
সে বলত, মন্তর বলে দিতে মানা আছে।
আমি জিগ্গেস করতুম, বলে দিলে কী হয়।
সে কেবল বলত, ও বাবা!
কী যে হয় জানাই হল না।— তার ভঙ্গি দেখে গা শিউরে উঠত। ঠিক করেছিলুম, একদিন যখন ইরু রাজবাড়িতে যাবে আমি যাব লুকিয়ে লুকিয়ে তার পিছনে পিছনে। কিন্তু সে যেত রাজবাড়িতে আমি যখন যেতুম ইস্কুলে। একদিন জিগ্গেস করেছিলুম, অন্য সময়ে গেলে কী হয়। আবার সেই ‘ও বাবা’। পীড়াপীড়ি করতে সাহসে কুলোত না।
আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে ইরু খুব একটা-কিছু মনে করত। হয়তো একদিন ইস্কুল থেকে আসতেই সে বলে উঠেছে, উঃ, সে কী পেল্লায় কাণ্ড।
ব্যস্ত হয়ে জিগ্গেস করেছি, কী কাণ্ড।
সে বলেছে, বলব না।
ভালোই করত— কানে শুনতুম কী একটা কাণ্ড, মনে বরাবর রয়ে যেত পেল্লায় কাণ্ড।
ইরু গিয়েছে হন্ত-দন্তর মাঠে, যখন আমি ঘুমোতুম। সেখানে পক্ষীরাজ ঘোড়া চরে বেড়ায়, মানুষকে কাছে পেলেই সে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যায় মেঘের মধ্যে।
আমি হাততালি দিয়ে বলে উঠতুম, সে তো বেশ মজা।
সে বলত, মজা বৈকি! ও বাবা!
কী বিপদ ঘটতে পারত শোনা হয় নি, চুপ করে গেছি মুখের ভঙ্গি দেখে। ইরু দেখেছে পরীদের ঘরকন্না— সে বেশি দূরে নয়। আমাদের পুকুরের পুব পাড়িতে যে চীনেবট আছে তারই মোটা মোটা
শিকড়গুলোর অন্ধকার ফাঁকে ফাঁকে। তাদের ফুল তুলে দিয়ে সে বশ করেছিল। তারা ফুলের মধু ছাড়া আর কিছু খায় না। ইরুর পরী-বাড়ি যাবার একমাত্র সময় ছিল দক্ষিণের বারান্দায় যখন নীলকমল মাস্টারের কাছে আমাদের পড়া করতে বসতে হত।
ইরুকে জিগ্গেস করতুম, অন্য সময় গেলে কী হয়।
ইরু বলত, পরীরা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়।
আরও অনেক কিছু ছিল তার অবাক-করা ঝুলিতে। কিন্তু, সবচেয়ে চমক লাগাত সেই না-দেখা রাজবাড়িটা। সে যে একেবারে আমাদের বাড়িতেই, হয়তো আমার শোবার ঘরের পাশেই। কিন্তু, মন্তর জানি নে যে। ছুটির দিনে দুপুর বেলায় ইরুর সঙ্গে গেছি আমতলায়, কাঁচা আম পেড়ে দিয়েছি, দিয়েছি তাকে আমার বহুমূল্য ঘষা ঝিনুক। সে খোসা ছাড়িয়ে শুল্পো শাক দিয়ে বসে বসে খেয়েছে কাঁচা আম, কিন্তু মন্তরের
কথা পাড়লেই বলে উঠেছে, ও বাবা।
তার পরে মন্তর গেল কোথায়, ইরু গেল শ্বশুরবাড়িতে, আমারও রাজবাড়ি খোঁজ করবার বয়স গেল পেরিয়ে— ঐ বাড়িটা রয়ে গেল গর-ঠিকানা। দূরের রাজবাড়ি অনেক দেখেছি, কিন্তু ঘরের কাছের রাজবাড়ি— ও বাবা।
*
* *
খেলনা খোকার হারিয়ে গেছে, মুখটা শুকোনো।
মা বলে, দেখ্, ঐ আকাশে আছে লুকোনো।
খোকা শুধোয়, ঘরের থেকে গেল কী ক’রে।
মা বলে যে, ঐ তো মেঘের থলিটা ভ’রে
নিয়ে গেছে ইন্দ্রলোকের শাসন-ছেঁড়া ছেলে।
খোকা বলে, কখন এল, কখন খবর পেলে।
মা বললে, ওরা এল যখন সবাই মিলি
চৌধুরিদের আমবাগানে লুকিয়ে গিয়েছিলি,
যখন ওদের ফলগুলো সব করলি বেবাক নষ্ট।
মেঘলা দিনে আলো তখন ছিল নাকো পষ্ট—
গাছের ছায়ার চাদর দিয়ে এসেছে মুখ ঢেকে,
কেউ আমরা জানি নে তো কজন তারা কে কে।
কুকুরটাও ঘুমোচ্ছিল লেজেতে মুখ গুঁজে,
সেই সুযোগে চুপিচুপি গিয়েছে ঘর খুঁজে।
আমরা ভাবি, বাতাস বুঝি লাগল বাঁশের ডালে,
কাঠবেড়ালি ছুটছে বুঝি আটচালাটার চালে।
তখন দিঘির বাঁধ ছাপিয়ে ছুটছে মাঠে জল,
মাছ ধরতে হো হো রবে জুটছে মেয়ের দল।
তালের আগা ঝড়ের তাড়ায় শূন্যে মাথা কোটে,
মেঘের ডাকে জানলাগুলো খড়্খড়িয়ে ওঠে।
ভেবেছিলুম, শান্ত হয়ে পড়ছ ক্লাসে তুমি,
জানি নে তো কখন এমন শিখেছ দুষ্টুমি।
খোকা বলে, ওই যে তোমার ইন্দ্রলোকের ছেলে—
তাদের কেন এমনতরো দুষ্টুমিতে পেলে।
ওরা যখন নেমে আসে আমবাগানের ’পরে—
ডাল ভাঙে আর ফল ছেঁড়ে আর কী কাণ্ডটাই করে।
আসল কথা, বাদল যেদিন বনে লাগায় দোল,
ডালে-পালায় লতায়-পাতায় বাধায় গণ্ডগোল—
সেদিন ওরা পড়াশুনোয় মন দিতে কি পারে,
সেদিন ছুটির মাতন লাগায় অজয়নদীর ধারে।
তার পরে সব শান্ত হলে ফেরে আপন দেশে,
মা তাহাদের বকুনি দেয়, গল্প শোনায় শেষে।
সংযোজন
ওকালতি ব্যবসায়ে ক্রমশই তার
ওকালতি ব্যবসায়ে ক্রমশই তার
জমেছিল একদিন মস্ত পসার।
ভাগ্যটা ঘাটে ঘাটে কী করিয়া শেষে
একদা জজের পদে ঠেকেছিল এসে।
সদাই বাড়িতে তার মহা ধুমধাম,
মুখে মুখে চারি দিকে রটে গেছে নাম।
আজ সে তো কালীনাথ, আগে ছিল কেলে—
কাউকে ফাঁসিতে দেয় কাউকে বা জেলে।
ক্লাসে ছিল একদিন একেবারে নিচু,
মাস্টার বলতেন হবে নাকো কিছু।
সব চেয়ে বোকারাম, সব চেয়ে হাঁদা—
দুষ্টুমি বুদ্ধিটা ছিল তার সাধা!
ক্লাসে ছিল বিখ্যাত তারি দৃষ্টান্ত,
সেই ইতিহাস তার সকলেই জানত।
একদিন দেখা গেল ছুটির বিকালে
ফলে ভরা আম গাছে একা বসি ডালে
কামড় লাগাতেছিল পাকা পাকা আমে—
ডাক পাড়ে মাস্টার, কিছুতে না নামে।
আম পেড়ে খেতে তোরে করেছি বারণ,
সে কথা শুনিস নে যে বল্ কী কারণ।
কালু বলে, পেড়ে আমি খাই নে তো তাই,
ডালে ব’সে ব’সে ফল ক’ষে কামড়াই।
মাস্টার বলে তারে, আয় তুই নাবি—
যত ফল খেয়েছিস তত চড় খাবি!
কালু বলে, পালিয়াছি গুরুর আদেশ
এই শাস্তিই যদি হয় তার শেষ,
তা হলে তো ভালো নয় পড়াশুনা করা—
গুরুর বচন শুনে চড় খেয়ে মরা।