বনোয়ারি স্তব্ধ হইয়া গেল। হরিদাসের এ প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিল না ।
হরিদাস কহিল, “ আমি যদি দিতে পারি আমাকে কী দিবে। ”
বনোয়ারির মনে হইল , হয়তো আর-কিছু । সে বলিল, “ আমার যাহা আছে সব তোকে দিব। ”
এ কথা সে পরিহাস করিয়াই বলিল ; সে জানে , তাহার কিছুই নাই ।
তখন হরিদাস আপন কাপড়ের ভিতর হইতে বনোয়ারির রুমালে-মোড়া সেই কাগজের তাড়া বাহির করিল। এই রঙিন রুমালটাতে বাঘের ছবি আঁকা ছিল ; সেই ছবি তাহার জ্যাঠা তাহাকে অনেকবার দেখাইয়াছে। এই রুমালটার প্রতি হরিদাসের বিশেষ লোভ। সেইজন্যেই অগ্নিদাহের গোলমালে ভৃত্যেরা যখন বাহিরে ছুটিয়াছিল সেই অবকাশে বাগানে আসিয়া হরিদাস চাঁপাতলায় দূর হইতে এই রুমালটা দেখিয়াই চিনিতে পারিয়াছিল।
হরিদাসকে বনোয়ারি বুকের কাছে টানিয়া লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; কিছুক্ষণ পরে তাহার চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহার মনে পড়িল , অনেকদিন পূর্বে সে তাহার এক নূতন-কেনা কুকুরকে শায়েস্তা করিবার জন্য তাহাকে বার বার চাবুক মারিতে বাধ্য হইয়াছিল । একবার তাহার চাবুক হারাইয়া গিয়াছিল , কোথাও সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। যখন চাবুকের আশা পরিত্যাগ করিয়া সে বসিয়া আছে এমন সময় দেখিল, সেই কুকুরটা কোথা হইতে চাবুকটা মুখে করিয়া মনিবের সম্মুখে আনিয়া পরমানন্দে লেজ নাড়িতেছে। আর-কোনোদিন কুকুরকে সে চাবুক মারিতে পারে নাই।
বনোয়ারি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, “ হরিদাস, তুই কী চাস্ আমাকে বল্। ”
হরিদাস কহিল , “ আমি তোমার ঐ রুমালটা চাই , জ্যাঠামশায় । ”
বনোয়ারি কহিল , “ আয় হরিদাস , তোকে কাঁধে চড়াই । ”
হরিদাসকে কাঁধে তুলিয়া লইয়া বনোয়ারি তৎক্ষণাৎ অন্তঃপুরে চলিয়া গেল। শয়নঘরে গিয়া দেখিল, কিরণ সারাদিন-রৌদ্রে-দেওয়া কম্বলখানি বারান্দা হইতে তুলিয়া আনিয়া ঘরের মেজের উপর পাতিতেছে। বনোয়ারির কাঁধের উপর হরিদাসকে দেখিয়া সে উদ্বিগ্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, “নামাইয়া দাও , নামাইয়া দাও। উহাকে তুমি ফেলিয়া দিবে । ”
বনোয়ারি কিরণের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, “ আমাকে আর ভয় করিয়ো না , আমি ফেলিয়া দিব না । ”
এই বলিয়া সে কাঁধ হইতে নামাইয়া হরিদাসকে কিরণের কোলের কাছে অগ্রসর করিয়া দিল । তাহার পরে সেই কাগজগুলি লইয়া কিরণের হাতে দিয়া কহিল , “ এগুলি হরিদাসের বিষয়সম্পত্তির দলিল । যত্ন করিয়া রাখিয়ো। ”
কিরণ আশ্চর্য হইয়া কহিল , “ তুমি কোথা হইতে পাইলে। ”
বনোয়ারি কহিল , “ আমি চুরি করিয়াছিলাম । ”
তাহার পর হরিদাসকে বুকে টানিয়া কহিল, “এই নে বাবা , তোর জ্যাঠামশায়ের যে মূল্যবান সম্পত্তিটির প্রতি তোর লোভ পড়িয়াছে , এই নে । ”
বলিয়া রুমালটি তাহার হাতে দিল ।
তাহার পর আর-একবার ভালো করিয়া কিরণের দিকে তাকাইয়া দেখিল । দেখিল , সেই তন্বী এখন তো তন্বী নাই, কখন মোটা হইয়াছে সে তাহা লক্ষ্য করে নাই । এতদিনে হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউয়ের উপযুক্ত চেহারা তাহার ভরিয়া উঠিয়াছে । আর কেন , এখন অমরুশতকের কবিতাগুলাও বনোয়ারির অন্য সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে বিসর্জন দেওয়াই ভালো ।
সেই রাত্রেই বনোয়ারির আর দেখা নাই । কেবল সে একছত্র চিঠি লিখিয়া গেছে যে , সে চাকরি খুঁজিতে বাহির হইল ।
বাপের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত সে অপেক্ষা করিল না! দেশসুদ্ধ লোক তাই লইয়া তাহাকে ধিক্ ধিক্ করিতে লাগিল ।
হৈমন্তী
কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন , মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে , কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে । মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে , কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে , সেইজন্যই তাড়া।
আমি ছিলাম বর, সুতরাং বিবাহসম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল। আমার কাজ আমি করিয়াছি , এফ.এ. পাস করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি। তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ , কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল।
আমাদের দেশে যে মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোনো উদ্বেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে । অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা থাকে না। যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাদের নবীন ছাত্রদের । বিবাহের পৌনঃপুনিক প্রস্তাবে তাহাদের পিতৃপক্ষের পাকা চুল কলপের আশীর্বাদে পুনঃপুনঃ কাঁচা হইয়া উঠে , আর প্রথম ঘটকালির আঁচেই ইহাদের কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার উপক্রম হয়।
সত্য বলিতেছি , আমার মনে এমন বিষম উদ্বেগ জন্মে নাই । বরঞ্চ বিবাহের কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিনে হাওয়া দিতে লাগিল। কৌতূহলী কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল । যাহাকে বার্কের ফ্রেঞ্চ্ রেভোল্যুশনের নোট পাঁচ-সাত খাতা মুখস্থ করিতে হইবে , তাহার পক্ষে এ ভাবটা দোষের । আমার এ লেখা যদি টেক্স্ট্বুক্-কমিটির অনুমোদিত হইবার কোনো আশঙ্কা থাকিত তবে সাবধান হইতাম।