বনোয়ারি এই দলিলগুলির বিবরণ কিছুই জানে না , কিন্তু এগুলি যে অত্যন্ত কাজের এবং ইহাদের অভাবে মামলা-মকদ্দমায় পদে পদে ঠকিতে হইবে তাহা সে বোঝে । কাগজগুলি লইয়া সে নিজের একটি রুমালে জড়াইয়া তাহাদের বাহিরের বাগানে চাঁপাতলায় বাঁধানো চাতালে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতে লাগিল ।
পরদিন শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে অলোচনা করিবার জন্য নীলকণ্ঠ বনোয়ারির কাছে উপস্থিত হইল । নীলকণ্ঠের দেহের ভঙ্গি অত্যন্ত বিনম্র , কিন্তু তাহার মুখের মধ্যে এমন একটা-কিছু ছিল , অথবা ছিল না , যাহা দেখিয়া অথবা কল্পনা করিয়া বনোয়ারির পিত্ত জ্বলিয়া গেল । তাহার মনে হইল , নম্রতার দ্বারা নীলকণ্ঠ তাহাকে ব্যঙ্গ করিতেছে ।
নীলকণ্ঠ বলিল , “ কর্তার শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে —”
বনোয়ারি তাহাকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিয়া উঠিল, “ আমি তাহার কী জানি। ”
নীলকণ্ঠ কহিল , “ সে কী কথা । আপনিই তো শ্রাদ্ধাধিকারী । ”
‘ মস্ত অধিকার! শ্রাদ্ধের অধিকার! সংসারে কেবল ঐটুকুতে আমার প্রয়োজন আছে — আমি আর কোনো কাজেরই না । ‘ বনোয়ারি গর্জিয়া উঠিল , “ যাও, যাও, আমাকে বিরক্ত করিয়ো না । ”
নীলকণ্ঠ গেল কিন্তু তাহার পিছন হইতে বনোয়ারির মনে হইল , সে হাসিতে হাসিতে গেল। বনোয়ারির মনে হইল, বাড়ির সমস্ত চাকরবাকর এই অশ্রদ্ধিত , এই পরিত্যক্তকে লইয়া আপনাদের মধ্যে হাসিতামাশা করিতেছে। যে মানুষ বাড়ির অথচ বাড়ির নহে , তাহার মতো ভাগ্যকর্তৃক পরিহসিত আর কে আছে। পথের ভিক্ষুকও নহে ।
বনোয়ারি সেই দলিলের তাড়া লইয়া বাহির হইল। হালদার-পরিবারের প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী জমিদার ছিল প্রতাপপুরের বাঁড়ুজ্যে জমিদারেরা। বনোয়ারি স্থির করিল , ‘এই দলিল-দস্তাবেজ তাহাদের হাতে দিব, বিষয়সম্পত্তি সমস্ত ছারখার হইয়া যাক। ‘
বাহির হইবার সময় হরিদাস উপরের তলা হইতে তাহার সুমধুর বালককণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিয়া কহিল , “ জ্যাঠামশায় , তুমি বাহিরে যাইতেছ , আমিও তোমার সঙ্গে বাহিরে যাইব। ”
বনোয়ারির মনে হইল, ‘বালকের অশুভগ্রহ এই কথা তাহাকে দিয়া বলাইয়া লইল। আমি তো পথে বাহির হইয়াছি, উহাকেও আমার সঙ্গে বাহির করিব । যাবে যাবে, সব ছারখার হইবে। ‘
বাহিরের বাগান পর্যন্ত যাইতেই বনোয়ারি একটা বিষম গোলমাল শুনিতে পাইল। অদূরে হাটের সংলগ্ন একটি বিধবার কুটিরে আগুন লাগিয়াছে । বনোয়ারির চিরাভ্যাসক্রমে এ দৃশ্য দেখিয়া সে আর স্থির থাকিতে পারিল না। তাহার দলিলের তাড়া সে চাঁপাতলায় রাখিয়া আগুনের কাছে ছুটিল।
যখন ফিরিয়া আসিল , দেখিল , তাহার সেই কাগজের তাড়া নাই । মুহূর্তের মধ্যে হৃদয়ে শেল বিঁধাইয়া এই কথাটা মনে হইল, ‘ নীলকণ্ঠের কাছে আবার আমার হার হইল । বিধবার ঘর জ্বালিয়া ছাই হইয়া গেলে তাহাতে ক্ষতি কী ছিল । ‘ তাহার মনে হইল , চতুর নীলকণ্ঠই ওটা পুনর্বার সংগ্রহ করিয়াছে ।
একেবারে ঝড়ের মতো সে কাছারিঘরে আসিয়া উপস্থিত। নীলকণ্ঠ তাড়াতাড়ি বাক্স বন্ধ করিয়া সসম্ভ্রমে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বনোয়ারিকে প্রণাম করিল । বনোয়ারির মনে হইল , ঐ বাক্সের মধ্যেই সে কাগজ লুকাইল । কোনো-কিছু না বলিয়া একেবারে সেই বাক্সটা খুলিয়া তাহার মধ্যে কাগজ ঘাঁটিতে লাগিল। তাহার মধ্যে হিসাবের খাতা এবং তাহারই জোগাড়ের সমস্ত নথি। বাক্স উপুড় করিয়া ঝাড়িয়া কিছুই মিলিল না ।
রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বনোয়ারি কহিল, “তুমি চাঁপাতলায় গিয়াছিলে?”
নীলকণ্ঠ বলিল , “ আজ্ঞা হাঁ , গিয়াছিলাম বৈকি । দেখিলাম , আপনি ব্যস্ত হইয়া ছুটিতেছেন, কী হইল তাহাই জানিবার জন্য বাহির হইয়াছিলাম। ”
বনোয়ারি। আমার রুমালে-বাঁধা কাগজগুলা তুমিই লইয়াছ ।
নীলকণ্ঠ নিতান্ত ভালোমানুষের মতো কহিল, “ আজ্ঞা , না । ”
বনোয়ারি । মিথ্যা কথা বলিতেছ । তোমার ভালো হইবে না , এখনি ফিরাইয়া দাও ।
বনোয়ারি মিথ্যা তর্জন গর্জন করিল । কী জিনিস তাহার হারাইয়াছে তাহাও সে বলিতে পারিল না এবং সেই চোরাই মাল সম্বন্ধে তাহার কোনো জোর নাই জানিয়া সে মনে মনে অসাবধান মূঢ় আপনাকেই যেন ছিন্ন ছিন্ন করিতে লাগিল ।
কাছারিতে এইরূপ পাগলামি করিয়া সে চাঁপাতলায় আবার খোঁজাখুঁজি করিতে লাগিল। মনে মনে মাতৃদিব্য করিয়া সে প্রতিজ্ঞা করিল, ‘ যে করিয়া হউক এ কাগজগুলা পুনরায় উদ্ধার করিব তবে আমি ছাড়িব। ‘ কেমন করিয়া উদ্ধার করিবে তাহা চিন্তা করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না, কেবল ক্রুদ্ধ বালকের মতো বার বার মাটিতে পদাঘাত করিতে করিতে বলিল, ‘ উদ্ধার করিবই , করিবই , করিবই। ‘
শ্রান্তদেহে সে গাছতলায় বসিল । কেহ নাই , তাহার কেহ নাই এবং তাহার কিছুই নাই। এখন হইতে নিঃসম্বলে আপন ভাগ্যের সঙ্গে এবং সংসারের সঙ্গে তাহাকে লড়াই করিতে হইবে। তাহার পক্ষে মানসম্ভ্রম নাই , ভদ্রতা নাই , প্রেম নাই , স্নেহ নাই , কিছুই নাই । আছে কেবল মরিবার এবং মারিবার অধ্যবসায়।
এইরূপ মনে মনে ছট্ফট্ করিতে করিতে নিরতিশয় ক্লান্তিতে চাতালের উপর পড়িয়া কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যখন জাগিয়া উঠিল তখন হঠাৎ বুঝিতে পারিল না, কোথায় সে আছে। ভালো করিয়া সজাগ হইয়া উঠিয়া বসিয়া দেখে তাহার শিয়রের কাছে হরিদাস বসিয়া। বনোয়ারিকে জাগিতে দেখিয়া হরিদাস বলিয়া উঠিল, “ জ্যাঠামশায় , তোমার কী হারাইয়াছে বলো দেখি। ”