বনোয়ারি অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাহিরের বারান্ডায় পায়চারি সমাধা করিয়া ঘরে আসিল । সে ভুলিয়া গিয়াছে যে , তাহার খাওয়া হয় নাই । কিরণ যে তাহার অপেক্ষায় না-খাইয়া বসিয়া আছে এই ঘটনাটা সেদিন যেন তাহাকে বিশেষ করিয়া আঘাত করিল । কিরণের এই কষ্টস্বীকারের সঙ্গে তাহার নিজের অকর্মণ্যতা যেন খাপ খাইল না । অন্নের গ্রাস তাহার গলায় বাধিয়া যাইবার জো হইল । বনোয়ারি অত্যন্ত উত্তেজনার সহিত স্ত্রীকে বলিল , “ যেমন করিয়া পারি মধুকৈবর্তকে আমি রক্ষা করিব । ” কিরণ তাহার এই অনাবশ্যক উগ্রতায় বিস্মিত হইয়া কহিল , “ শোনো একবার! তুমি তাহাকে বাঁচাইবে কেমন করিয়া । ”
মধুর দেনা বনোয়ারি নিজে শোধ করিয়া দিবে এই তাহার পণ , কিন্তু বনোয়ারির হাতে কোনোদিন তো টাকা জমে না । স্থির করিল , তাহার তিনটে ভালো বন্দুকের মধ্যে একটা বন্দুক এবং একটা দামি হীরার আংটি বিক্রয় করিয়া সে অর্থ সংগ্রহ করিবে । কিন্তু , গ্রামে এ-সব জিনিসের উপযুক্ত মূল্য জুটিবে না এবং বিক্রয়ের চেষ্টা করিলে চারি দিকে লোকে কানাকানি করিবে । এইজন্য কোনো-একটা ছুতা করিয়া বনোয়ারি কলিকাতায় চলিয়া গেল । যাইবার সময় মধুকে ডাকিয়া আশ্বাস দিয়া গেল , তাহার কোনো ভয় নাই ।
এ দিকে বনোয়ারির শরণাপন্ন হইয়াছে বুঝিয়া , নীলকণ্ঠ মধুর উপরে রাগিয়া আগুন হইয়া উঠিয়াছে । পেয়াদার উৎপীড়নে কৈবর্তপাড়ার আর মানসম্ভ্রম থাকে না ।
কলিকাতা হইতে বনোয়ারি যেদিন ফিরিয়া আসিল সেই দিনই মধুর ছেলে স্বরূপ হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটিয়া আসিয়া একেবারে বনোয়ারির পা জড়াইয়া ধরিয়া হাউহাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল । “ কী রে কী , ব্যাপারখানা কী । ” স্বরূপ বলিল, তাহার বাপকে নীলকণ্ঠ কাল রাত্রি হইতে কাছারিতে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে । বনোয়ারির সর্বশরীর রাগে কাঁপিতে লাগিল । কহিল , “ এখনি গিয়া থানায় খবর দিয়া আয় গে । ”
কী সর্বনাশ। থানায় খবর! নীলকণ্ঠের বিরুদ্ধে ! তাহার পা উঠিতে চায় না । শেষকালে বনোয়ারির তাড়নায় থানায় গিয়া সে খবর দিল । পুলিস হঠাৎ কাছারিতে আসিয়া বন্ধনদশা হইতে মধুকে খালাস করিল এবং নীলকণ্ঠ ও কাছারির কয়েকজন পেয়াদাকে আসামী করিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চালান করিয়া দিল ।
মনোহর বিষম ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন । তাঁহার মকদ্দমার মন্ত্রীরা ঘুষের উপলক্ষ করিয়া পুলিসের সঙ্গে ভাগ করিয়া টাকা লুটিতে লাগিল । কলিকাতা হইতে এক বারিস্টার আসিল , সে একেবারে কাঁচা , নূতন-পাস-করা । সুবিধা এই , যত ফি তাহার নামে খাতায় খরচ পড়ে তত ফি তাহার পকেটে উঠে না। ও দিকে মধুকৈবর্তের পক্ষে জেলা-আদালতের একজন মাতব্বর উকিল নিযুক্ত হইল । কে যে তাহার খরচ জোগাইতেছে বোঝা গেল না। নীলকণ্ঠের ছয় মাস মেয়াদ হইল । হাইকোর্টের আপিলেও তাহাই বহাল রহিল ।
ঘড়ি এবং বন্দুকটা যে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় হইয়াছে তাহা ব্যর্থ হইল না — আপাতত মধু বাঁচিয়া গেল এবং নীলকণ্ঠের জেল হইল । কিন্তু , এই ঘটনার পরে মধু তাহার ভিটায় টিঁকিবে কী করিয়া। বনোয়ারি তাহাকে আশ্বাস দিয়া কহিল , “ তুই থাক্ , তোর কোনো ভয় নাই । ” কিসের জোরে যে আশ্বাস দিল তাহা সেই জানে — বোধ করি , নিছক নিজের পৌরুষের স্পর্ধায় ।
বনোয়ারি যে এই ব্যাপারের মূলে আছে তাহা সে লুকাইয়া রাখিতে বিশেষ চেষ্টা করে নাই । কথাটা প্রকাশ হইল ; এমন-কি , কর্তার কানেও গেল । তিনি চাকরকে দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন , “ বনোয়ারি যেন কদাচ আমার সম্মুখে না আসে । ” বনোয়ারি পিতার আদেশ অমান্য করিল না ।
কিরণ তাহার স্বামীর ব্যবহার দেখিয়া অবাক । এ কী কাণ্ড । বাড়ির বড়োবাবু — বাপের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ! তার উপরে নিজেদের আমলাকে জেলে পাঠাইয়া বিশ্বের লোকের কাছে নিজের পরিবারের মাথা হেঁট করিয়া দেওয়া! তাও এই এক সামান্য মধুকৈবর্তকে লইয়া!
অদ্ভুত বটে! এ বংশে কতকাল ধরিয়া কত বড়োবাবু জন্মিয়াছে এবং কোনোদিন নীলকণ্ঠেরও অভাব নাই । নীলকণ্ঠেরা বিষয়ব্যবস্থার সমস্ত দায় নিজেরা লইয়াছে আর বড়োবাবুরা সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্টভাবে বংশগৌরব রক্ষা করিয়াছে । এমন বিপরীত ব্যাপার তো কোনোদিন ঘটে নাই।
আজ এই পরিবারের বড়োবাবুর পদের অবনতি ঘটাতে বড়োবউয়ের সম্মানে আঘাত লাগিল । ইহাতে এতদিন পরে আজ স্বামীর প্রতি কিরণের যথার্থ অশ্রদ্ধার কারণ ঘটিল । এতদিন পরে তাহার বসন্তকালের লট্কানে- রঙের শাড়ি এবং খোঁপার বেলফুলের মালা লজ্জায় ম্লান হইয়া গেল ।
কিরণের বয়স হইয়াছে অথচ সন্তান হয় নাই । এই নীলকণ্ঠই একদিন কর্তার মত করাইয়া পাত্রী দেখিয়া বনোয়ারির আর-একটি বিবাহ প্রায় পাকাপাকি স্থির করিয়াছিল । বনোয়ারি হালদারবংশের বড়ো ছেলে , সকল কথার আগে এ কথা তো মনে রাখিতে হইবে । সে অপুত্রক থাকিবে , ইহা তো হইতেই পারে না । এই ব্যাপারে কিরণের বুক দুর্দুর্ করিয়া কাঁপিয়া উঠিয়াছিল । কিন্তু , ইহা সে মনে মনে না স্বীকার করিয়া থাকিতে পারে নাই যে , কথাটা সংগত । তখনো সে নীলকণ্ঠের উপরে কিছুমাত্র উপরে কিছুমাত্র রাগ করে নাই , সে নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিয়াছে । তাহার স্বামী যদি নীলকণ্ঠের রাগিয়া মারিতে না যাইত এবং বিবাহসম্বন্ধ ভাঙিয়া দিয়া পিতামাতার সঙ্গে রাগারাগি না করিত তবে কিরণ সেটাকে অন্যায় মনে করিত না । এমন-কি , বনোয়ারি যে তাহার বংশের কথা ভাবিল না , ইহাতে অতি গোপনে কিরণের মনে বনোয়ারির পৌরুষের প্রতি একটু অশ্রদ্ধাই হইয়াছিল । বড়ো ঘরের দাবি কি সামান্য দাবি । তাহার যে নিষ্ঠুর হইবার অধিকার আছে । তাহার কাছে কোনো তরুণী স্ত্রীর কিম্বা কোনো দুঃখী কৈবর্তের সুখদুঃখের কতটুকুই বা মূল্য!