প্রথমেই সে তাহার বাহিরের ঘরে নীলকণ্ঠকে ডাকাইয়া আনিল এবং দেনার দায়ে মধুকৈবর্তকে নষ্ট করিতে নিষেধ করিল । নীলকণ্ঠ কহিল , মধুকে যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহা হইলে এই তামাদির মুখে বিস্তর টাকা বাকি পড়িবে ; সকলেই ওজর করিতে আরম্ভ করিবে। বনোয়ারি তর্কে যখন পারিল না তখন যাহা মুখে আসিল গাল দিতে লাগিল। বলিল, ছোটোলোক। নীলকণ্ঠ কহিল , “ ছোটোলোক না হইলে বড়োলোকের শরণাপন্ন হইব কেন। ” বলিল, চোর । নীলকণ্ঠ বলিল, “সে তো বটেই , ভগবান যাহাকে নিজের কিছুই দেন নাই, পরের ধনেই তো সে প্রাণ বাঁচায়। ” সকল গালিই সে মাথায় করিয়া লইল; শেষকালে বলিল, “ উকিলবাবু বসিয়া আছেন , তাঁহার সঙ্গে কাজের কথাটা সারিয়া লই । যদি দরকার বোধ করেন তো আবার আসিব। ”
বনোয়ারি ছোটো ভাই বংশীকে নিজের দলে টানিয়া তখনই বাপের কাছে যাওয়া স্থির করিল । সে জানিত, একলা গেলে কোনো ফল হইবে না, কেননা , এই নীলকণ্ঠকে লইয়াই তাহার বাপের সঙ্গে পূর্বেই তাহার খিটিমিটি হইয়াছে। বাপ তাহার উপর বিরক্ত হইয়াই আছেন। একদিন ছিল যখন সকলেই মনে করিত, মনোহরলাল তাঁহার বড়ো ছেলেকেই সব চেয়ে ভালোবাসেন। কিন্তু , এখন মনে হয়, বংশীর উপরেই তাঁহার পক্ষপাত। এইজন্যই বনোয়ারি বংশীকেও তাহার নালিশের পক্ষভুক্ত করিতে চাহিল।
বংশী , যাহাকে বলে , অত্যন্ত ভালো ছেলে । এই পরিবারের মধ্যে সে-ই কেবল দুটো এক্জামিন পাস করিয়াছে । এবার সে আইনের পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে । দিনরাত জাগিয়া পড়া করিয়া করিয়া তাহার অন্তরের দিকে কিছু জমা হইতেছে কি না অন্তর্যামী জানেন কিন্তু শরীরের দিকে খরচ ছাড়া আর কিছুই নাই ।
এই ফাল্গুনের সন্ধ্যায় তাহার ঘরে জানলা বন্ধ । ঋতুপরিবর্তনের সময়টাকে তাহার ভারি ভয় । হাওয়ার প্রতি তাহার শ্রদ্ধামাত্র নাই । টেবিলের উপর একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলিতেছে। কতক বই মেজের উপরে চৌকির পাশে রাশীকৃত , কতক টেবিলের উপরে ; দেয়ালে কুলুঙ্গিতে কতকগুলি ঔষধের শিশি ।
বনোয়ারির প্রস্তাবে সে কোনোমতেই সম্মত হইল না । বনোয়ারি রাগ করিয়া গর্জিয়া উঠিল , “ তুই নীলকণ্ঠকে ভয় করিস! ” বংশী তাহার কোনো উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া রহিল । বস্তুতই নীলকণ্ঠকে অনুকূল রাখিবার জন্য তাহার সর্বদাই চেষ্টা । সে প্রায় সমস্ত বৎসর কলিকাতার বাসাতেই কাটায় ; সেখানে বরাদ্দ টাকার চেয়ে তাহার বেশি দরকার হইয়াই পড়ে । এই সূত্রে নীলকণ্ঠকে প্রসন্ন রাখাটা তাহার অভ্যস্ত ।
বংশীকে ভীরু , কাপুরুষ , নীলকণ্ঠের চরণ-চারণ-চক্রবর্তী বলিয়া খুব একচোট গালি দিয়া বনোয়ারি একলাই বাপের কাছে গিয়া উপস্থিত । মনোহরলাল তাঁহাদের বাগানে দিঘির ঘাটে তাঁহার নধর শরীরটি উদ্ঘাটন করিয়া আরামে হাওয়া খাইতেছেন । পারিষদগণ কাছে বসিয়া কলিকাতার বারিস্টারের জেরায় জেলাকোর্টে অপর পল্লীর জমিদার অখিল মজুমদার যে কিরূপ নাকাল হইয়াছিল তাহারই কাহিনী কর্তাবাবুর শ্রুতিমধুর করিয়া রচনা করিতেছিল । সেদিন বসন্তসন্ধ্যার সুগন্ধ বায়ু-সহযোগে সেই বৃত্তান্তটি তাঁহার কাছে অত্যন্ত রমণীয় হইয়া উঠিয়াছিল ।
হঠাৎ বনোয়ারি তাহার মাঝখানে পড়িয়া রসভঙ্গ করিয়া দিল । ভূমিকা করিয়া নিজের বক্তব্য কথাটা ধীরে ধীরে পাড়িবার মতো অবস্থা তাহার ছিল না । সে একেবারে গলা চড়াইয়া শুরু করিয়া দিল , নীলকণ্ঠের দ্বারা তাহাদের ক্ষতি হইতেছে । সে চোর , সে মনিবের টাকা ভাঙিয়া নিজের পেট ভরিতেছে । কথাটার কোনো প্রমাণ নাই এবং তাহা সত্যও নহে । নীলকণ্ঠের দ্বারা বিষয়ের উন্নতি হইয়াছে , এবং সে চুরিও করে না । বনোয়ারি মনে করিয়াছিল , নীলকণ্ঠের সৎস্বভাবের প্রতি অটল বিশ্বাস আছে বলিয়াই কর্তা সকল বিষয়েই তাহার ‘ পরে এমন চোখ বুজিয়া নির্ভর করেন । এটা তাহার ভ্রম । মনোহরলালের মনে নিশ্চয় ধারণা যে নীলকণ্ঠ সুযোগ পাইলে চুরি করিয়া থাকে । কিন্তু, সেজন্য তাহার প্রতি তাঁহার কোনো অশ্রদ্ধা নাই । কারণ , আবহমান কাল এমনি ভাবেই সংসার চলিয়া আসিতেছে । অনুচরগণের চুরির উচ্ছিষ্টেই তো চিরকাল বড়োঘর পালিত । চুরি করিবার চাতুরী যাহার নাই , মনিবের বিষয়রক্ষা করিবার বুদ্ধিই বা তাহার জোগাইবে কোথা হইতে । ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়া তো জমিদারির কাজ চলে না । মনোহর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন , “ আচ্ছা , আচ্ছা , নীলকণ্ঠ কী করে না-করে সে কথা তোমাকে ভাবিতে হইবে না । ” সেই সঙ্গে ইহাও বলিলেন , “ দেখো দেখি , বংশীর তো কোনো বালাই নাই । সে কেমন পড়াশুনা করিতেছে। ঐ ছেলেটা তবু একটু মানুষের মতো । ”
ইহার পরে অখিল মজুমদারের দুর্গতিকাহিনীতে আর রস জমিল না । সুতরাং , মনোহরলালের পক্ষে সেদিন বসন্তের বাতাস বৃথা বহিল এবং দিঘির কালো জলের উপর চাঁদের আলোর ঝক্ঝক্ করিয়া উঠিবার কোনো উপযোগিতা রহিল না । সেদিন সন্ধ্যাটা কেবল বৃথা হয় নাই বংশী এবং নীলকণ্ঠের কাছে । জানলা বন্ধ করিয়া বংশী অনেক রাত পর্যন্ত পড়িল এবং উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া করিয়া নীলকণ্ঠ অর্ধেক রাত কাটাইয়া দিল ।
কিরণ ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া জানলার কাছে বসিয়া । কাজকর্ম আজ সে সকাল-সকাল সারিয়া লইয়াছে। রাত্রের আহার বাকি, কিন্তু এখনো বনোয়ারি খায় নাই , তাই সে অপেক্ষা করিতেছে । মধুকৈবর্তের কথা তাহার মনেও নাই । বনোয়ারি যে মধুর দুঃখের কোনো প্রতিকার করিতে পারে না , এ সম্বন্ধে কিরণের মনে ক্ষোভের লেশমাত্র ছিল না । তাহার স্বামীর কাছ হইতে কোনোদিন সে কোনো বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পাইবার জন্য উৎসুক নহে । পরিবারের গৌরবেই তাহার স্বামীর গৌরব । তাহার স্বামী তাহার শ্বশুরের বড়ো ছেলে, ইহার চেয়ে তাহাকে যে আরো বড়ো হইতে হইবে , এমন কথা কোনোদিন তাহার মনেও হয় নাই । ইহারা যে গোঁসাইগঞ্জের সুবিখ্যাত হালদার-বংশ!