একদিন এই ধনসম্পদে তাহারই অবাধ অধিকার তো জন্মিবে । কিন্তু যৌবন কি চিরদিন থাকিবে ? বসন্তের রঙিন পেয়ালায় তখন এ সুধারস এমন করিয়া আপনা-আপনি ভরিয়া উঠিবে না ; টাকা তখন বিষয়ীর টাকা হইয়া খুব শক্ত হইয়া জমিবে , গিরিশিখরের তুষারসংঘাতের মতো, তাহাতে কথায় কথায় অসাবধানের অপব্যয়ের ঢেউ খেলিতে থাকিবে না । টাকার দরকার তো এখনই , যখন আনন্দে তাহা নয়-ছয় করিবার শক্তি নষ্ট হয় নাই ।
বনোয়ারির প্রধান শখ তিনটি — কুস্তি , শিকার এবং সংস্কৃতচর্চা । তাহার খাতার মধ্যে সংস্কৃত উদ্ভটকবিতা একেবারে বোঝাই করা । বাদলার দিনে , জ্যোৎস্নারাত্রে , দক্ষিনা হাওয়ায়, সেগুলি বড়ো কাজে লাগে । সুবিধা এই , নীলকণ্ঠ এই কবিতাগুলির অলংকারবাহুল্যকে খর্ব করিতে পারে না । অতিশয়োক্তি যতই অতিশয় হউক , কোনো খাতাঞ্চি-সেরেস্তায় তাহার জন্য জবাবদিহি নাই । কিরণের কানের সোনায় কার্পণ্য ঘটে কিন্তু তাহার কানের কাছে যে মন্দাক্রান্তা গুঞ্জরিত হয় তাহার ছন্দে একটি মাত্রাও কম পড়ে না এবং তাহার ভাবে কোনো মাত্রা থাকে না বলিলেই হয় ।
লম্বাচওড়া পালোয়নের চেহারা বনোয়ারির । যখন সে রাগ করে তখন তাহার ভয়ে লোকে অস্থির । কিন্তু , এই জোয়ান লোকটির মনের ভিতরটা ভারি কোমল । তাহার ছোটো ভাই বংশীলাল যখন ছোটো ছিল তখন সে তাহাকে মাতৃস্নেহে লালন করিয়াছে । তাহার হৃদয়ে যেন একটি লালন করিবার ক্ষুধা আছে ।
তাহার স্ত্রীকে সে যে ভলোবাসে তাহার সঙ্গে এই জিনিসটিও জড়িত , এই লালন করিবার ইচ্ছা । কিরণলেখা তরুচ্ছায়ার মধ্যে পথহারা রশ্মিরেখাটুকুর মতোই ছোটো , ছোটো বলিয়াই সে তাহার স্বামীর মনে ভারি একটা দরদ জাগাইয়া রাখিয়াছে ; এই স্ত্রীকে বসনে ভূষণে নানারকম করিয়া সাজাইয়া দেখিতে তাহার বড়ো আগ্রহ । তাহা ভোগ করিবার আনন্দ নহে , তাহা রচনা করিবার আনন্দ ; তাহা এককে বহু করিবার আনন্দ , কিরণলেখাকে নানা বর্ণে নানা আবরণে নানারকম করিয়া দেখিবার আনন্দ ।
কিন্তু , কেবলমাত্র সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করিয়া বনোয়ারির এই শখ কোনোমতেই মিটিতেছে না । তাহার নিজের মধ্যে একটি পুরুষোচিত প্রভুশক্তি আছে তাহাও প্রকাশ করিতে পারিল না , আর প্রেমের সামগ্রীকে নানা উপকরণে ঐশ্বর্যবান করিয়া তুলিবার যে ইচ্ছা তাহাও তার পূর্ণ হইতেছে না ।
এমনি করিয়াই এই ধনীর সন্তান তাহার মানমর্যাদা , তাহার সুন্দরী স্ত্রী , তাহার ভরা যৌবন — সাধারণত লোকে যাহা কামনা করে তাহার সমস্ত লইয়াও সংসারে একদিন একটা উৎপাতের মতো হইয়া উঠিল ।
সুখদা মধুকৈবর্তের স্ত্রী , মনোহরলালের প্রজা । সে একদিন অন্তঃপুরে আসিয়া কিরণলেখার পা জড়াইয়া ধরিয়া কান্না জুড়িয়া দিল । ব্যাপারটা এই — বছর কয়েক পূর্বে নদীতে বেড়জাল ফেলিবার আয়োজন-উপলক্ষে অন্যান্য বারের মতো জেলেরা মিলিয়া একযোগে খৎ লিখিয়া মনোহরলালের কাছারিতে হাজার টাকা ধার লইয়াছিল । ভালোমত মাছ পড়িলে সুদে আসলে টাকা শোধ করিয়া দিবার কোনো অসুবিধা ঘটে না ; এইজন্য উচ্চ সুদের হারে টাকা লইতে ইহারা চিন্তামাত্র করে না । সে বৎসর তেমন মাছ পড়িল না, এবং ঘটনাক্রমে উপরি উপরি তিন বৎসর নদীর বাঁকে মাছ এত কম আসিল যে জেলেদের খরচ পোষাইল না , অধিকন্তু তাহারা ঋণের জালে বিপরীত রকম জড়াইয়া পড়িল । যে-সকল জেলে ভিন্ন এলেকার তাহাদের আর দেখা পাওয়া যায় না ; কিন্তু , মধুকৈবর্ত ভিটাবাড়ির প্রজা , তাহার পলাইবার জো নাই বলিয়া সমস্ত দেনার দায় তাহার উপরেই চাপিয়াছে । সর্বনাশ হইতে রক্ষা পাইবার অনুরোধ লইয়া সে কিরণের শরণাপন্ন হইয়াছে । কিরণের শাশুড়ির কাছে গিয়া কোনো ফল নাই তাহা সকলেই জানে ; কেননা, নীলকণ্ঠের ব্যবস্থায় কেহ যে আঁচড়টুকু কাটিতে পারে এ কথা তিনি কল্পনা করিতেও পারেন না । নীলকণ্ঠের প্রতি বনোয়ারির খুব একটা আক্রোশ আছে জানিয়াই মধুকৈবর্ত তাহার স্ত্রীকে কিরণের কাছে পাঠাইয়াছে ।
বনোয়ারি যতই রাগ এবং যতই আস্ফালন করুক , কিরণ নিশ্চয় জানে যে , নীলকণ্ঠের কাজের উপর হস্তক্ষেপ করিবার কোনো অধিকার তাহার নাই । এইজন্য কিরণ সুখদাকে বার বার করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল , “ বাছা , কী করব বলো । জানই তো এতে আমাদের কোনো হাত নেই । কর্তা আছেন , মধুকে বলো , তাঁকে গিয়ে ধরুক । ”
সে চেষ্টা তো পূর্বেই হইয়াছে । মনোহরলালের কাছে কোনো বিষয়ে নালিশ উঠিলেই তিনি তাহার বিচারের ভার নীলকণ্ঠের ‘ পরেই অর্পণ করেন , কখনোই তাহার অন্যথা হয় না । ইহাতে বিচারপ্রার্থীর বিপদ আরো বাড়িয়া উঠে । দ্বিতীয়বার কেহ যদি তাঁহার কাছে আপিল করিতে চায় তাহা হইলে কর্তা রাগিয়া আগুন হইয়া উঠেন — বিষয়কর্মের বিরক্তিই যদি তাঁহাকে পোহাইতে হইল তবে বিষয় ভোগ করিয়া তাঁহার সুখ কী।
সুখদা যখন কিরণের কাছে কান্নাকাটি করিতেছে তখন পাশের ঘরে বসিয়া বনোয়ারি তাহার বন্দুকের চোঙে তেল মাখাইতেছিল । বনোয়ারি সব কথাই শুনিল । কিরণ করুণকণ্ঠে যে বার বার করিয়া বলিতেছিল যে তাহারা ইহার কোনো প্রতিকার করিতে অক্ষম , সেটা বনোয়ারির বুকে শেলের মতো বিঁধিল ।
সেদিন মাঘীপূর্ণিমা ফাল্গুনের আরম্ভে আসিয়া পড়িয়াছে । দিনের বেলাকার গুমট ভাঙিয়া সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ একটা পাগলা হাওয়া মাতিয়া উঠিল । কোকিল তো ডাকিয়া ডাকিয়া অস্থির ; বার বার এক সুরের আঘাতে সে কোথাকার কোন্ ঔদাসীন্যকে বিচলিত করিবার চেষ্টা করিতেছে । আর , আকাশে ফুলগন্ধের মেলা বসিয়াছে , যেন ঠেলাঠেলি ভিড়; জানলার ঠিক পাশেই অন্তঃপুরের বাগান হইতে মুচুকুন্দফুলের গন্ধ বসন্তের আকাশে নিবিড় নেশা ধরাইয়া দিল । কিরণ সেদিন লট্কানের-রঙ-করা একখানি শাড়ি এবং খোঁপায় বেলফুলের মালা পরিয়াছে । এই দম্পতির চিরনিয়ম অনুসারে সেদিন বনোয়ারির জন্যও ফাল্গুন-ঋতুযাপনের উপযোগী একখানি লট্কানে-রঙিন চাদর ও বেলফুলের গোড়েমালা প্রস্তুত । রাত্রির প্রথম প্রহর কাটিয়া গেল তবু বনোয়ারির দেখা নাই । যৌবনের ভরা পেয়ালাটি আজ তাহার কাছে কিছুতেই রুচিল না । প্রেমের বৈকুণ্ঠলোকে এতবড়ো কুণ্ঠা লইয়া সে প্রবেশ করিবে কেমন করিয়া । মধুকৈবর্তের দুঃখ দূর করিবার ক্ষমতা তাহার নাই , সে ক্ষমতা আছে নীলকণ্ঠের! এমন কাপুরুষের কণ্ঠে পরাইবার জন্য মালা কে গাঁথিয়াছে ।