কিন্তু, তবু সেই জিনিসপত্র বাঁধিলেন, টিকিট কিনিলেন এবং গাড়িও চড়িলেন।
এবং একদিন শীতের সায়াহ্নে বাড়ির দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। আশ্বিন মাসে শরতের প্রাতঃকালে দ্বারের কাছে বসিয়া বৈদ্যনাথ অনেক প্রবাসীকে বাড়ি ফিরিতে দেখিয়াছেন, এবং দীর্ঘশ্বাসের সহিত মনে মনে এই বিদেশ হইতে দেশে ফিরিবার সুখের জন্য লালায়িত হইয়াছেন-তখন আজিকার সন্ধ্যা স্বপ্নেরও অগম্য ছিল।
বাড়িতে প্রবেশ করিয়া প্রাঙ্গণের কাষ্ঠাসনে নির্বোধের মতো বসিয়া রহিলেন, অন্তঃপুরে গেলেন না। সর্বপ্রথমে ঝি তাঁহাকে দেখিয়া আনন্দ কোলাহল বাধাইয়া দিল-ছেলেরা ছুটিয়া আসিল, গৃহিণী ডাকিয়া পাঠাইলেন।
বৈদ্যনাথের যেন একটা ঘোর ভাঙিয়া গেল, আবার যেন তাঁহার সেই পূর্বসংসারে জাগিয়া উঠিলেন।
শুষ্কমুখে মান হাস্য লইয়া একটা ছেলেকে কোলে করিয়া, একটা ছেলের হাত ধরিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন।
তখন ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হইয়াছে, এবং যদিও রাত হয় নাই তথাপি শীতের সন্ধ্যা রাত্রির মতো নিস্তব্ধ হইয়া আসিয়াছে।
বৈদ্যনাথ খানিকণ কিছু বলিলেন না, তার পর মৃদুস্বরে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন আছ।”
স্ত্রী তাহার কোনো উত্তর না দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইল।”
বৈদ্যনাথ নিরুত্তরে কপালে আঘাত করিলেন। মোক্ষদার মুখ ভারি শক্ত হইয়া উঠিল।
ছেলেরা প্রকাণ্ড একটা অকল্যাণের ছায়া দেখিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া গেল। ঝির কাছে গিয়া বলিল, “সেই নাপিতের গল্প বল্।” বলিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল।
রাত হইতে লাগিল, কিন্তু দুজনের মুখে একটি কথা নাই। বাড়ির মধ্যে কী-একটা যেন ছম্ছম্ করিতে লাগিল এবং মোক্ষদার ঠোঁটদুটি ক্রমশই বজ্রের মতো আঁটিয়া আসিল।
অনেকক্ষণ পরে মোক্ষদা কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে শয়নগৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন।
বৈদ্যনাথ চুপ করিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিলেন। চৌকিদার প্রহর হাঁকিয়া গেল। শ্রান্ত পৃথিবী অকাতর নিদ্রায় মগ্ন হইয়া রহিল। আপনার আত্মীয় হইতে আরম্ভ করিয়া অনন্ত আকাশের নত্র পর্যন্ত কেহই এই লাঞ্ছিত ভগ্ননিদ্র বৈদ্যনাথকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিল না।
অনেক রাত্রে, বোধ করি কোনো স্বপ্ন হইতে জাগিয়া বৈদ্যনাথের বড়ো ছেলেটি শয্যা ছাড়িয়া আস্তে আস্তে বারান্দায় আসিয়া ডাকিল, “বাবা।” তখন তাহার বাবা সেখানে নাই।
অপেক্ষাকৃত ঊর্ধ্বকণ্ঠে রুদ্ধ দ্বারের বাহির হইতে ডাকিল, “বাবা।” কিন্তু কোনো উত্তর পাইল না।
আবার ভয়ে ভয়ে বিছানায় গিয়া শয়ন করিল।
পূর্বপ্রথানুসারে ঝি সকালবেলায় তামাক সাজিয়া তাঁহাকে খুঁজিল, কোথাও দেখিতে পাইল না। বেলা হইলে প্রতিবেশিগণ গৃহপ্রত্যাগত বান্ধবের খোঁজ লইতে আসিল, কিন্তু বৈদ্যনাথের সহিত সাক্ষাৎ হইল না।
ভাদ্র-আশ্বিন / ১২৯৯ বঃ
হালদারগোষ্ঠী
এই পরিবারটির মধ্যে কোনোরকমের গোল বাধিবার কোনো সংগত কারণ ছিল না । অবস্থাও সচ্ছল , মানুষগুলিও কেহই মন্দ নহে কিন্তু তবুও গোল বাধিল ।
কেননা , সংগত কারণেই যদি মানুষের সব-কিছু ঘটিত তবে তো লোকালয়টা একটা অঙ্কের খাতার মতো হইত , একটু সাবধানে চলিলেই হিসাবে কোথাও কোনো ভুল ঘটিত না ; যদি বা ঘটিত সেটাকে রবার দিয়া মুছিয়া সংশোধন করিলেই চলিয়া যাইত ।
কিন্তু , মানুষের ভাগ্যদেবতার রসবোধ আছে ; গণিতশাস্ত্রে তাঁহার পাণ্ডিত্য আছে কি না জানি না , কিন্তু অনুরাগ নাই ; মানবজীবনের যোগবিয়োগের বিশুদ্ধ অঙ্ক-ফলটি উদ্ধার করিতে তিনি মনোযোগ করেন না । এইজন্য তাঁহার ব্যবস্থার মধ্যে একটা পদার্থ তিনি সংযোগ করিয়াছেন , সেটা অসংগতি । যাহা হইতে পারিত সেটাকে সে হঠাৎ আসিয়া লন্ডভন্ড করিয়া দেয় । ইহাতেই নাট্যলীলা জমিয়া উঠে , সংসারের দুই কূল ছাপাইয়া হাসিকান্নার তুফান চলিতে থাকে ।
এ ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিল — যেখানে পদ্মবন সেখানে মত্তহস্তী আসিয়া উপস্থিত । পঙ্কের সঙ্গে পঙ্কজের একটা বিপরীত রকমের মাখামাখি হইয়া গেল; তা না হইলে এ গল্পটির সৃষ্টি হইতে পারিত না ।
যে পরিবারের কথা উপস্থিত করিয়াছি তাহার মধ্যে সব চেয়ে যোগ্য মানুষ যে বনোয়ারিলাল , তাহাতে সন্দেহ নাই । সে নিজেও তাহা বিলক্ষণ জানে এবং সেইটেতেই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে । যোগ্যতা এঞ্জিনের স্টীমের মতো তাহাকে ভিতর হইতে ঠেলে ; সামনে যদি সে রাস্তা পায় তো ভালোই , যদি না পায় তবে যাহা পায় তাহাকে ধাক্কা মারে ।
তাঁহার বাপ মনোহরলালের ছিল সাবেককেলে বড়োমানুষি চাল । যে সমাজ তাঁহার সেই সমাজের মাথাটিকেই আশ্রয় করিয়া তিনি তাহার শিরোভূষণ হইয়া থাকিবেন , এই তাঁহার ইচ্ছা । সুতরাং সমাজের হাত-পায়ের সঙ্গে তিনি কোনো সংস্রব রাখেন না । সাধারণ লোকে কাজকর্ম করে , চলে ফেরে ; তিনি কাজ না-করিবার ও না-চলিবার বিপুল আয়োজনটির কেন্দ্রস্থলে ধ্রুব হইয়া বিরাজ করেন ।
প্রায় দেখা যায় , এইপ্রকার লোকেরা বিনাচেষ্টায় আপনার কাছে অন্তত দুটি-একটি শক্ত এবং খাঁটি লোককে যেন চুম্বকের মতো টানিয়া আনেন । তাহার কারণ আর কিছু নয় , পৃথিবীতে একদল লোক জন্মায় সেবা করাই তাহাদের ধর্ম । তাহারা আপন প্রকৃতির চরিতার্থতার জন্যই এমন অক্ষম মানুষকে চায় যে- লোক নিজের ভার ষোলোআনাই তাহাদের উপর ছাড়িয়া দিতে পারে । এই সহজ সেবকেরা নিজের কাজে কোনো সুখ পায় না, কিন্তু আর-একজনকে নিশ্চিন্ত করা , তাহাকে সম্পূর্ণ আরামে রাখা , তাহাকে সকলপ্রকার সংকট হইতে বাঁচাইয়া চলা , লোকসমাজে তাহার সম্মানবৃদ্ধি করা , ইহাতেই তাহাদের পরম উৎসাহ । ইহারা যেন একপ্রকারের পুরুষ মা ; তাহাও নিজের ছেলের নহে , পরের ছেলের ।