*
সুন্দরপুরের রমাকান্ত মাস্টার অভ্যাশবশত উঠোনে বসে সকালের রোদ পোহাচ্ছিলেন একদিন। এমন সময় পোস্টাফিসের পিয়ন এসে তার হাতে একটা মোটা প্যাকেট দিয়ে চলে যায়। ঢাকা থেকে এসেছে পার্সেলটি। প্রেরক ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার নামের এক আইনজীবি। বিস্মিত মাস্টার ঘরে না গিয়ে উঠোনে বসেই প্যাকেটটা খুলে দেখেন অলোকনাথ বসুর সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ তাকে ট্রাস্টি করে দান করা হয়েছে। ঢাকায় গিয়ে আইনজীবির সাথে বসে বাকি কাগজপত্র তৈরি করার জন্য তাকে অনুরোধ করে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ছোট্ট একটি চিরকুট।
রমাকান্তকামার বুঝতে পারলেন ওটা কার। অলোকনাথের নাতবৌ সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বোবা ছেলেটার মাধ্যমে এরকম হাতের লেখা চিরকুট পাঠিয়ে তাকে জমিদার বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেছিলো। মহিলার কাছ থেকে প্রস্তাবটা শুনে ভিরমি খেয়েছিলেন মাস্টার। এতো বড় সহায় সম্পত্তি হ্রট করে তার মতো একজনের কাছে কেন দিতে চাইছে? তার সাথে তো মিসেস জুবেরির কখনও কথা-ই হয় নি। সুন্দরপরে আসার পর মহিলা দুয়েকবার লোক পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছিলো, তিনি যান নি।
প্রস্তাবটা শোনার পর অনেকক্ষণ চুপ থাকেন মাস্টার। কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলেন, আর এ কথাটা মিসেস জুবেরির কাছে অকপটে বলেছিলেন তিনি। ভদ্রমহিলা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলো, এমপি আসাদুল্লাহকে নিয়ে তিনি যেনো কোনো দুর্ভাবনায় না থাকেন। তার সামান্য পরিমাণ ক্ষতি করার মতো অবস্থায়ও থাকবে না ঐ এমপি! মহিলার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে।
গভীর করে দম নিয়ে চিরকুটটায় চোখ বোলালেন তিনি। খুব বেশি কথা লেখা নেই সেখানে।
সম্পদ-সম্পত্তি খারাপ মানুষের হাতে পড়লে দশের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। ভালো মানুষের হাতে পড়লে মহৎ কিছুর জন্ম হয়। আপনি এ সম্পত্তি নিয়ে কি করবেন সে নিয়ে আমার মধ্যে কোনো সংশয় নেই। শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ, রবীন্দ্রনাথকে চমৎকার একটি লাইব্রেরি বানাবেন। বইয়ের চেয়ে শক্তিশালী খাবার এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়। নি। ওই লাইব্রেরিটা যদি রবীন্দ্রনাথের নামে হয় তাহলে আমি ভীষণ খুশি হবো। একটা কথা মনে রাখবেন, এটা আমি আপনাকে দেই নি।
রাশেদ জুবেরি তার জীবন বাঁচানোর জন্য আপনার কাছে চিরটাকালই কৃতজ্ঞ ছিলো। সে হয়তো মুখ ফুটে সেটা কখনও বলতে পারে নি।
—ভালো থাকবেন।
রমাকান্তকামার শীতের নরম রোদে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তার ঘোলাটে দু-চোখে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো একটি দৃশ্য। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা বুকে বই-খাতা জড়িয়ে দৌড়ে যাচ্ছে একটি স্কুলের দিকে। লাইব্রেরিতে মৌন-পাঠকের দল ডুব মেরে আছে অন্য এক জগতে!