“স্যার, দুটো ঘটনা মোটেও কাকতালীয় নয়। আমি নিশ্চিত, এটা মুশকান জুবেরির কাজ।”।
“কি?” আৎকে উঠলো ছফা। “কি বলতে চাচ্ছো? ওই মহিলা ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে…তাছাড়া তুমি বলছো এমপি হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেছে, তাহলে মুশকান জুবেরিকে সন্দেহ করার কারণ কি?”
“স্যার, সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। খবরটা শোনার পর আমিও ভেবেছিলাম কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু টিভিতে নিউজটা দেখার পর বুঝলাম এটা মুশকান জুবেরিই করেছে।”
“একটু খুলে বলবে?” অধৈর্য হয়ে উঠলো ছফা।
“এমপি আসাদুল্লাহ কোথায় থাকে জানেন, স্যার?”
“না।“
“গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে। আর ঐ ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদও থাকেন একই অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে।”
“মাইগড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো ছফা।
.
উপসংহার
মুশকান জুবেরিকে ধরা না গেলেও নুরে ছফা বেশ বাহবা পেলো উর্ধতন কর্মকর্তার কাছ থেকে। এমন কি শেষ ভিক্টিম হাসিবের মামা প্রধানমন্ত্রীর। কার্যালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিটিও ফোন করে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। যে কেসটার কোনো কূল-কিণারা কেউ করতে পারে নি, সামান্য অগ্রগতিও দেখাতে পারে নি সেখানে ছফা যতোটুকু করেছে তা তো বিস্ময়করই বটে। হ্যাঁ, আসামীকে ধরা যায় নি, তাতে কি? তাকে ধরার কাজ এখনও অব্যাহত আছে। যেকোনো সময় ঐ মহিলাকে ধরা সম্ভব হবে।
কর্তাদের এমন কথায় অবশ্য ছফা মনে মনে একমত হতে পারে নি। তার ধারণা, মুশকান জুবেরি চিরকালের জন্য ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এরপক্ষে যুক্তি দিতে পারবে না সে, তবে এটাই তার দৃঢ় বিশ্বাস। সুন্দরপুরের এমপি মারা যাবার কথা শুনে এ নিয়ে কমিশনারের কাছে গিয়ে বলেছিলো, ঘটনাটা নিছক হার্ট-অ্যাটাকের না-ও হতে পারে। একই ফ্ল্যাটে মুশকানের ঘনিষ্ঠ ডা: আসকার ইবনে সায়িদ থাকেন। এই ভদ্রলোক মুশকানের প্রায় সব ব্যাপারই জানেন। যদিও পাঁচজন ভিক্টিমের ব্যাপারটা তিনি জানতেন না বলেই দাবি করেছেন। ছফার কাছ থেকে এ কথা শুনে কমিশনার বলেছেন, ফরেনসিক রিপোর্টে যদি সন্দেহজনক কিছু থাকে তাহলে এটা নিয়ে তারা তদন্ত করে দেখতে পারে, কিন্তু নিছক একই ফ্ল্যাটে বসবাস করার জন্য এরকম সন্দেহ করাটা ধোপে টিকবে না। এই সন্দেহটা প্রমাণের জন্য শক্ত প্রমাণ দরকার।
ছফা সেই প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করে শেষে হতাশ হয়েছে। এমপির মৃত্যুর কারণ হিসেবে ফরেনসিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে অতিরিক্ত মদ্যপানকে, সেটাও আবার সরকারী দলের হস্তক্ষেপের কারণে ধামাচাপা পড়ে গেছে। সেই রিপোর্ট প্রকাশ করা তো দূরের কথা, দেখারও সুযোগ হয়নি কারোর। ছফা অনেক চেষ্টা করে শুধু এটুকুই জানতে পেরেছে। সুতরাং এমপি আসাদুল্লাহর কেসটা নিয়ে এগিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলো কিনতু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এমপি মারা যাবার পরদিনই ভদ্রলোক কী একটা কাজে আমেরিকায় চলে গেছেন, কবে ফিরবেন কেউ জানে না।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলেও কেএস খানের সাথে তার দেখা হয় নি। এর কারণ আরেকটি কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ভদ্রলোক।
ডাক্তারের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ছফা ফোন দেয় সাবেক ডিবি ইনভেস্টিগেরটকে। কেএসকে জানায় কয়েকদিন ব্যস্ত থাকার পর আজ বাড়িতে আছে বিশ্রাম নেবার জন্য। তার শরীর একটু খারাপ। কথাটা শুনে। মুচকি হেসেছিলো সে। মি. খানের শরীর কবে ভালো ছিলো মনে করার চেষ্টা করলো। কিংবা কখনও সে তাকে বলেছে কিনা তার শরীর আজ ভালো, মনে পড়লো না।
“স্যার, তাহলে আমি আসছি আপনার বাসায়, একটু গল্প করে যাই। অনেকদিন দেখা হয় না,” বলেই ফোনটা রেখে দিলো ছফা।
*
জমিদার বাড়িটি পুড়ে যাবার পর এমপি আসাদুল্লাহর মৃত্যু সুন্দরপুরকে একটু নাড়িয়ে দিলেও দু-সপ্তাহ পরই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। কেবল রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি বাদে!
অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টটি সেই যে বন্ধ হয়েছে আর খোলে নি। এর কর্মচারিরা কোথায় চলে গেছে, কে তাদের চলে যেতে বলেছে সেটা কেউ জানে না। এখনও অনেকেই রবীন্দ্রনাথের সামনে গাড়ি থামিয়ে হতাশ হয়ে দেখতে পায় দরজা-জানালা সব বন্ধ। চমৎকার আর অদভুত সাইনটাও জ্বলছে না। তাদের বেশিরভাগই রাস্তার ওপাড়ে রহমান মিয়ার টঙ দোকানে। গিয়ে জানতে চায় ঘটনা কি। শুরুতে এই এক কথা বলতে বলতে রহমানের মেজাজ প্রায়ই বিগড়ে যেতো, লোকজনের এইসব প্রশ্ন করা যেনো অচিরেই বন্ধ হয়ে যায় সেই কামনাই করতো মনে মনে, তবে দ্রুতই সে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা তার জন্য লাভজনক হয়ে উঠছে। যারা জিজ্ঞেস করতে আসে তাদের মধ্যে কেউ কেউ হতাশ হয়ে তার চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা সিগারেট খায়। তাই রহমান মিয়াও তার বিজনেস পলিসি বদলে ফেললো : রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে খোঁজ করতে আসলেই সে এখন বলে, “সামনের মাস থিইকা আবার চালু হইবো।” এরকম পাক্কা খবর নাকি তার কাছে আছে।
এ কথা শুনে হতাশ কাস্টমাররা কিছুটা আশা নিয়ে ফিরে যায়। যাবার আগে কেউ কেউ তার বিখ্যাত গুড়ের চা-ও খায়, সেইসঙ্গে সিগারেট।
ওদিকে আতর আলী প্রায় এক সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরে আসে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেও সুস্থ হতে খুব বেশি সময় নেয় নি সে। আবারো থানার ইনফর্মার হয়ে কাজ করছে, তবে আগের মতো আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয় না তাকে। হাজার হলেও নুরে ছফার মতো জাঁদরেল লোকজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, যাকে ওসি তো ওসি, স্বয়ং এসপিও সমীহ করে চলে। এরমধ্যে দুয়েকবার ছফা ফোন করে তার খোঁজখবরও নিয়েছে। তার হাতে এখন যে নতুন মোবাইলফোনটা আছে সেটা ছফাই ঢাকা থেকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। এই উপহারের কথা সে সবখানে বলে বেড়ায়। লোকে যাতে বোঝে, ঐ নুরে ছফা তাকে কি চোখে দেখে। এখনও সে রহমান মিয়ার দোকানে এসে চা খায়, সিগারেট কেনে, কিন্তু দোকানি আর তার। অগোচরে তাকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলে না।