মাথাব্যথা কেটে যাবার পর সমস্ত ক্লান্তি অপসারিত হতেই মনে হলো সুন্দরপুরের খবর নেয়া দরকার। গতকাল এসপিকে ফোন দিয়েছিলো ঘটনা কি জানার জন্য কিন্তু হারামজাদা তার ফোন ধরে নি। ওকে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রান্সফার করতে হবে। পরক্ষণেই ভুল ভাঙলো তার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রভাবশালী একজনের কারণেই তার বিশ্বস্ত আর ঘনিষ্ঠ এসপি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি তাকেও হাতপা গুটিয়ে রাখতে হয়েছে ঐ লোকের ভয়ে। নইলে মুশকানকে সাহায্য করা তার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিলো না। বরং তার গোয়াতুর্মি আর অধৈর্যের কারণে যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা ঘোচানোর সুযোগ পাওয়া যেতো মেয়েটার বিপদে সাহায্য করে।
মুশকানের কথা ভাবতেই একটা প্রশ্নের উদয় হলো তার মনে সে কি এমন করেছে, যার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঐ লোক ক্ষেপে আছে? কিছুক্ষণ ভেবেও আন্দাজ করতে পারলো না। ঠিক করলো আগামীকাল সকালে যেভাবেই হোক এসপির সাথে যোগাযোগ করে এটা জেনে নেবে, যদি আদৌ সে সবটা জেনে থাকে।
হঠাৎ করে শোবার ঘরের খোলা দরজার দিকে তাকালো। বাইরের প্যাসেজ আর ড্রইংরুমের আলো নেভানো। আসাদুল্লাহ নিশ্চিত, অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময় সবগুলো বাতি জ্বালিয়েছিলো। একটু আগে যখন ফ্রিজ থেকে ওয়াইনের বোতলটা নিয়ে এলো তখনও বাতি জুলছিলো। পরক্ষণেই আবার অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলো সে। মাতাল হিসেবে এরকম ভুল হতেই পারে।
মদের গ্লাসটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে এসে ডানে বামে তাকালো সে। এই সুরক্ষিত অ্যাপার্টমেন্টে কে টুকবে? অসম্ভব। মুচকি হাসলো আসাদুল্লাহ্ ক্ষমতাবানদের নিরাপত্তাহীনতা বোধ একটু বেশিই থাকে, যেটা বাইরের লোকজন বুঝতে পারে না সব সময়। শোবার ঘরের বাইরে প্যাসেজের বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে সোফায় এসে বসলো আবার। গ্লাসটা খালি করে ভরে নিলো আরেক দফা। কিছুক্ষণ পর টের পেলো মদ কাজ করতে শুরু করেছে। কেমন হালকা হয়ে এসেছে মাথাটা! চোখ দুটো ভারি হয়ে আসছে৷ গ্লাসটা খালি করে সোফার হাতলের উপর রেখে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে। একটু পর কিছু একটা টের পেয়ে খোলা দরজার দিকে তাকালো সে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আবছায়া এক নারীমূর্তি!
কে?
অবয়বটি আস্তে আস্তে হেঁটে তার বিছানার কাছে চলে এলো। ঘরের বাতি নেভানো বলে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে না। বাইরের আলোয় অবয়বটি আবছায়া মূর্তি দেখে তার মনে হলো এই নারী তার অনেক দিনের চেনা।
“কে?” এবার মুখ দিয়ে কথাটা বের করতে পারলো। “মুশকান?”
“ঘরছাড়া এই পাগলটাকে এমন করে কে গো ডাকে করুণ গুঞ্জরি,” নারীকণ্ঠটি প্রায় ফিসফিসিয়ে, সুরে সুরে বলে উঠলো, “যখন বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়াই সঞ্চরি।”
আসাদুল্লাহর কাছে মনে হলো সে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছে। তার সামনে যে নারী দাঁড়িয়ে আছে তার সান্নিধ্য পাবার জন্য সে কতোটা ব্যাকুল তা কেউ না জানুক সে নিজে তো জানে। এই নারী তাকে পাগল করে তুলেছে। বার বার ফিরিয়ে দিয়ে অপমান করেছে তাকে। শেষে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর মরিয়া হয়ে জোর খাটাতে শুরু করেছে ইদানিং, কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। মুশকান এমন ভাব করে, যেনো তার সমস্ত হম্বি-তম্বি শিশুতোষ পাগলামি ছাড়া আর কিছু না।
নারীমূর্তিটি তার মুখের উপর কিছুটা ঝুঁকে এলো। যেনো তাকে ভালো করে দেখছে। আসাদুল্লাহ আবছা আবছা দেখতে পেলো মুখটি। সেই রহস্য!
সেই দুর্দমনীয় আকর্ষণ! প্রলুব্ধকর চাহনি!
“ভয় পাচ্ছো?” বলে উঠলো মুশকান। “দেখো, আমি তোমার ঘরে চলে এসেছি! তোমার জায়গায় আমি হলে প্রাণ খুলে গাইতাম ‘এসে এসো আমার ঘরে এসো…” সুরে সুরে গানটা গেয়ে আচমকা থেমে গেলো। “তোমার কাছ থেকে অবশ্য এটা আশা করাটাও বোকামি। তুমি একটা মাথামোটা ভাঁড়!”
এমপি পিটপিট করে তাকালো শুধু।
“তুমি ভয় পাচ্ছো?”
বুঝতে পারলো না তাকে কেন এ প্রশ্ন করা হচ্ছে।
“ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি মোটেও খাওয়ার যোগ্য নও!”
তারপরই নিঃশব্দে হেসে উঠলো সে। সেই হাসির কি অর্থ বুঝতে পারলো না আসাদুল্লাহ। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার সময় মুশকানের আদরমাখা কণ্ঠটি।
“তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও. আমি তোমাকে খাবো না!”
*
ঢাকায় আসার পরদিনই অফিসে চলে গেলো নুরে ছফা। ইচ্ছে করলে কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিতে পারতো, কিন্তু ব্যাচেলর মানুষের আর যাইহোক নিজের ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে ভালো লাগে না। তাছাড়া এমন কিছু হয় নি যে বিশ্রাম নেবার দরকার আছে।
অফিসে এসেই কয়েকজন কলিগের সাথে দেখা করে নিজের ঘরে গিয়ে কয়েকটি পত্রিকা নিয়ে বসলো। কমিশনার এলে তাকে পুরো ব্যাপারটা ব্রিফ করতে হবে। পত্রিকা খুলতেই তার সহকারি জাওয়াদ ঢুকলো ঘরে। তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা দেখতে পেলো ছফা।
“স্যার, ঘটনা শুনেছেন?”
“কি?”
“সুন্দরপুরের এমপি মারা গেছে গতরাতে!”
ভুরু কুচকে ফেললো সে।
“কিভাবে মারা গেলো? কোথায় মারা গেলো?”
“হার্ট অ্যাটাকে, স্যার…নিজের ফ্ল্যাটে।”
“ব্যাপারটা খুব কাকতালীয় হয়ে গেলো না?” পত্রিকা নামিয়ে রাখলো সে। “গতপরশু সুন্দরপুরে এতোবড় একটা ঘটনা ঘটলো আবার গতরাতে সেই এলাকার এমপি মারা গেলো…স্ট্রেইঞ্জা”।