বুক সমান পানিতে নেমেই কয়েকবার ডুব দিলো নগ্ন মুশকান। এখন যদি নির্জন এই রাতে কেউ তাকে দেখেও ফেলে ভুত-প্রেত ছাড়া আর কিছু ভাববে না।
হাত-মুখ আর শরীর থেকে ফেসিয়াল-প্যাকগুলো ঘষে ঘষে মুছে ফেলার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর ডোবা থেকে উঠে দ্রুত পরে নিলো সালোয়ার কামিজ। জিপে উঠে বসলো আবারো, তবে এই গাড়িটা বেশিক্ষণ ব্যবহার করতে পারবে না, তাকে খুব দ্রুত এটা পরিত্যাগ করতে হবে।
গাড়ির হুইল ধরে রাস্তার দিকে চোখ রেখে একটু ভেবে নিলো মুশকান। এ-মুহূর্ত যাবার মতো একটা ঠিকানাই আছে। আর সেটা অন্য একটি জরুরি কাজ করার জন্যেও উপযুক্ত জায়গা।
.
অধ্যায় ৪৩
সুন্দরপুরের জমিদার বাড়িটি চিতার মতোই জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গেছে। খবর পাবার চল্লিশ মিনিট পর ফায়ারসার্ভিসের একটা গাড়ি চলে এলেও ততোক্ষণে পুরো বাড়িটিতে আগুন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, দুটো হোস পাইপ দিয়ে আগুন নেভানোটা বালখিল্য বলেই মনে হয়েছে স্বয়ং ফায়ারম্যানদের কাছে। বলতে গেলে সারারাত ধরেই আগুন জ্বলেছে, আর সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে অল্প কিছু মানুষ।
রাতকানা মেয়েটিকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই তার জ্ঞান ফেরে। সে যা বললো, তা শুনে এসপি মনোয়ার এবং থানার ওসি হতভম্ব। তাদের সামনে দিয়ে, তাদের চোখে ধুলো দিয়ে, রীতিমতো বোকা বানিয়ে মুশকান জুবেরি সটকে পড়েছে। আর তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে স্বয়ং পুলিশ!
থানার যে গাড়িটা করে মিসেস জুবেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেই গাড়ির ড্রাইভার আধঘন্টা পর এসে জানায় কি ঘটনা ঘটে গেছে। মনোয়ার হোসেন সব শুনে হতবাক হয়ে থাকে বেশ কয়েক মিনিট। আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়া একজন মহিলা কিভাবে এটা করতে পারলো? তার তো বেঁচে থাকা নিয়েই সন্দেহ ছিলো। ড্রাইভার অবশ্য জানতে না পোড়া মেয়েটিই মুশকান জুবেরি। এসপি আর ওসি যখন তাকে এটা বললো সে চুপ মেরে গেলো। পুরো ব্যাপারটাই পুলিশের কাছে রহস্যময়। তারা এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেলো না। মুশকান জুবেরি কিভাবে আগুনে পোড়ার ধোঁকা দিতে পারলো সেটা মাথায় ঢুকছে না।
রাত দুটোর দিকে ব্যর্থমনোরথে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে আসে এসপি। আর সুন্দরপুরের ওসি তার লোকজন নিয়ে নেমে পড়ে বাড়িটার আশেপাশে তল্লাশীর কাজে। দু-জন কনস্টেবলকে মেইনগেটে পাহারায় বসিয়ে দেয়। দোতলা বাড়িটি ভেতর থেকে ভেঙে পড়লেও সম্মুভাগটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিলো। আগুনের শিখা নিভে গেলেও ছাইচাপা আগুন জ্বলেছে ভোর পর্যন্ত। ভোরের আজান যখন ভেসে আসছিলো দুরের কোনো মসজিদ থেকে তখনই একটা ঘটনা ঘটে বাড়ির পেছনে বাগানে। ঐ সময় পুলিশের লোজন জোড়পুকুর পাড়ের পাশে জলাশয়ের মধ্যে কুমিরগুলো খুঁজে পেয়েছে মাত্র। বিশাল জলাশয়ের একটি অংশ কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে আলাদা করা। তার মধ্যেই বিচরণ করতে দেখে বেশ কয়েকটি কুমিরের বাচ্চাকে। এটা নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত ঠিক তখনই এক কনস্টেবল চিৎকার করে ওঠে বাড়ির পেছনে থাকা ঔষধি বাগান থেকে। ওসি নিজে পড়িমরি করে তার লোকজন নিয়ে ছুটে যায় সেখানে। তারা গিয়ে দেখতে পায় বাগানের একটা ঝোপের আড়ালে ঘাসের উপরে ভারি কম্বলে ঢাকা একটি লাশ! মুখটা দেখেই ওসি চিনতে পারে, এটা নুরে ছফা। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্নই নেই, একেবারে অক্ষত৷ যেনো ঘুমিয়ে আছে।
এসআই আনোয়ারই প্রথম খেয়াল করে ছফার বুক ওঠানামা করছে। মৃদু। সঙ্গে সঙ্গে ডিবির এই কর্মকর্তাকে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। এসপিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফোন করে এ ঘটনা জানানো হয়। কথাটা শুনে মনোয়ার হোসেন যতোটা না বিস্মিত হয়। তারচেয়েও বেশি হাফ ছেড়ে বাঁচে। তাহলে নুরে ছফা আগুনে পুড়ে মারা যায় নি। তাকে জীবিত উদ্ধারের কথা বলতে হবে এখন, আর এটাই তাদের মুখ। কিছুটা রক্ষা করবে।
সঙ্গে সঙ্গে ওসিকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে দেয় এসপি। ওসিও এটাই চাইছিলো। তাকেও তো কিছু করে দেখাতে হবে। মুশকান জুবেরি তাদের সামনে দিয়ে, তাদেরই সহায়তায় পালিয়ে গেছে-এই ব্যর্থতা ঢেকে ফেলতে হবে। সুতরাং পুলিশ তাদের রিপোর্টে জানালো, ছফাকে নীচতলার বাড়ির ভেতর থেকে অক্ষত উদ্ধার করা হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে ওসি আর এসআই আনোয়ার জীবনের ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠিত ছিলো না। স্বয়ং এসপিসাহেবের যোগ্য নেতৃত্বে এটা করা হয়।
*
পরদিন সকালে সুন্দরপুরের সবাই জেনে গেলো ঘটনাটি। তবে কি কারণে মুশকান জুবেরি পালালো আর তার বাড়িটা আগুনে পুড়ে গেলো সেটা নিয়ে কারোর কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। এক একজন মনের মাধুরি মিশিয়ে গল্প। বলে যেতে লাগলো। বলাই বাহুল্য, গল্পগুলো মুখরোচক।
তবে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এসে যখন দেখতে পেলো রবীন্দ্রনাথ বন্ধ তখন অবাক হয়ে একে-ওকে জিজ্ঞেস করেও আসল কারণটা জানতে পারলো না।
“ওই হোটেল আর জীবনেও খুলবো না, বুঝলেন?” মেজাজের সাথে কথাটা বললো রবীন্দ্রনাথের উল্টো দিকের টঙ দোকানি রহমান মিয়া।
“কেন, কি হয়েছে?” একজন ভদ্রলোক উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো।
“আরে, হে কি আমারে কইয়া গেছে ক্যান বন্ধ কইরা দিছে?” ঝাঁঝের সাথে জবাব দিলো রহমান।