এই ড্রাগসটি প্রথমে পা দুটো অসাড় করে দেয়। ছফা সম্ভবত এটা টের পেলেও মনে করেছিলো তার পায়ে ঝি-ঝি ধরেছে। কিছুক্ষণ বসে থাকলে এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। পা থেকে ওটা যখন হাতে গিয়ে পৌঁছায় তখন ছফার টের পাবার কথা ছিলো কিন্তু সে ডুবে গেছিলো আন্দিজের কাহিনীতে। অবশেষে তার মুখটাও যখন বন্ধ হয়ে গেলো তখন আর কিছুই করার ছিলো না। মুশকান জানে, ঐ সময়ে ছফার চিন্তা-ভাবনাগুলোও বেশ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলো-পুরোপুরি অচেতন হবার আগে এমনটিই হবার কথা।
এরপর ঘরে থাকা অনেকগুলো ফেসিয়াল-প্যাক থেকে একটি প্যাক নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। পুরো একটি টিউব ব্যবহার করে হাতে-মুখে-পায়ে আর গলার নীচে মেখে নেয়। প্যাকের অবশিষ্ট আঠালো তরল মেখে নেয় চুলে। এলোমেলো আর বিতস্ত্র করে ফেলে তার সুন্দর রেশমি চুলগুলো। ফেসিয়াল প্যাক দ্রুত শুকিয়ে গেলে আয়নায় দেখে সন্তুষ্ট হয় সে। আগুনে ঝলসে যাওয়া ভিক্টিমদেরও এরচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর লাগে না!
ছফাকে নিয়ে কি করবে সেটা আগে থেকে ঠিক করে রাখে নি। সে শুধু চেয়েছিলো লোকটাকে অচেতন করে ফেলতে। তবে তার বাড়িতে ফালুর লুকিয়ে থাকাটা বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। গোরখোদককে পালাতে সাহায্য করা হবে এই আশ্বাসে তাকে দিয়ে ছোট্ট একটা কাজ করিয়ে নেয়। তার ধারণা পুলিশ এটা দ্রুতই আবিষ্কার করবে।
এরপর ফালুকে পালানোর সুযোগ করে দেয়। ছেলেটাকে বলে দিয়েছে। জোড়পুকুরের দক্ষিণে যে ভাঙা মন্দিরটা আছে, ওটার সামনের দিকে জলাশয় দিয়ে সাবধানে সাঁতরে গেলে সে এখান থেকে পালাতে পারবে।
নীচে নামার সময় দোতলার ল্যান্ডিংয়ে সাফিনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। রাতের বেলায় কিছু দেখতে পায় না, তাই কান পেতে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করছিলো। তার সৎভাই ফালুর সাথে কি করা হচ্ছে সেই কৌতূহল চেপে রাখতে পারে নি। তাকে ল্যান্ডিংয়ে দেখতে পেয়েই মুশকান সতর্ক শিকারী পশুর মতো নিঃশব্দ হয়ে যায়। তারপরও মেয়েটা কিভাবে যেনো টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, রেলিং ধরে তড়িঘড়ি নীচে নামতে শুরু করে। ঠিক তখনই পেছন থেকে মেয়েটার মুখে ক্লোরোফর্মের রুমাল চেপে ধরে। তাকে অচেতন করে নীচতলার ভেতরের দিকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে গা থেকে শাড়িটা খুলে ফেলে। সে চায় নি আসন্ন জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে পড়ে মেয়েটার কোনো ক্ষতি হোক। সম্ভবত মেয়েটা অক্ষতই আছে।
বোবা ইয়াকুব আরেকটুর জন্য সমস্যা বাঁধিয়ে দিতো। আর কেউ না চিনুক তাকে ওভাবে দেখেও ইয়াকুব ঠিকই চিনতে পেরেছিলো। সেটাই স্বাভাবিক। দিনের পর দিন যে শরীরটা ভোগ করতো সেটা অন্য যে কারোর চেয়ে তার কাছে বেশিই চেনা। সুতরাং বোবাকে ধোঁকা দিতে পারে নি। পুলিশের কারণে সে কিছু করতেও পারে নি। তাকে মাটিতে ফেলে দু-দুজন মানুষ চেপে ধরে রেখেছিলো।
নীচতলা দিয়ে বের হবার আগে শেষবারের মতো দোতলায় যায় সে আগুন লাগাতে। মুশকানের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিলো এটাই। কাঠের মেঝে আর সিঁড়ি, বাড়িতে প্রচুর কাঠের আসবাব, গ্যাস-বার্নার আর অ্যালকোহলের কারণে আগুন ধরানোটা এমন কোনো ব্যাপার ছিলো না কিন্তু বাড়িটার প্রতি মায়া জন্মে গেছিলো তার। এই কয়েক বছরে বাড়িটা সত্যিকার অর্থেই ঠিকানা হয়ে উঠেছিলো তার। নিজের ঠিকানা ধ্বংস করা মোটেও সহজ কাজ নয়। তারপরও সেটা করতে হয়েছে। আর এটা করতে গিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিলো ভেতর থেকে। সে বুঝতে পারছিলো, এই জীবনে আর স্থায়ি ঠিকানা বলে কিছু থাকবে না। আন্দিজের পর থেকে সে থিতু হতে পারে নি। অনেক চেষ্টা করেছে, আমেরিকা ছেড়ে চলে এসেছে। ঢাকায়, তারপরও সে টিকতে পারে নি। সুন্দরপুরও তার জন্য শেষ পর্যন্ত আরেকটি ফেলে আসা অধ্যায় হয়ে গেলো।
সব প্রস্তুতি শেষে সাফিনার শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেবার পর তার প্রিয় রেডওয়াইনের একটি বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে কিছুটা পান করে, বাকিটুকু ঢেলে দেয় মাথায়। রক্তসদৃশ্য রেডওয়াইন মাথা থেকে সারামুখে ছড়িয়ে পড়ে। তারপরই গভীর করে দম নিয়ে নীচতলায় নেমে যায় চিৎকার দিতে দিতে। গ্রামটানে তার চিৎকার সবাইকে আরেকবার ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়।
মুশকান ভেবেছিলো তাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিতে কমপক্ষে দু জন পুলিশ থাকবে গাড়িতে, কিন্তু তা হয় নি। মাত্র একজন ড্রাইভারকে কায় নেয়া এমন কোনো কঠিন কাজ নয়, বিশেষ করে গুলিভর্তি পিস্তল হাতে থাকলে।
রাস্তার পাশে একটা ঝুপডির পাশে জিপটা থামালো সে। সুন্দরপুর থেকে গাড়ি চালিয়ে অসংখ্যবার এ পথ দিয়ে ঢাকায় গেছে। পথের দু-ধারে সবই তার চেনা। এই ঘরটি কাঠ কিংবা এরকম কিছু রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখন ওটা বন্ধ। চারপাশে কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। পিস্তলটা হাতে নিয়ে জিপ থেকে নেমে পড়লো। ঝুপড়িটার পেছনে একটা ডোবা আছে। জায়গাটা বেছে নেবার দুটো কারণের মধ্যে এটা অন্যতম। ঝুপড়ি ঘরটার পেছনে গিয়ে শরীর থেকে শাড়িটা খুলে ফেললো। অন্ধকারেই নেমে পড়লো ডোবায়। শীতের এমন রাতে তীব্র ঠাণ্ডা পানি তাকে বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারলো না। এরচয়েও বেশি ঠাণ্ডায় বেঁচে ছিলো, একদিন নয় দুদিন নয় প্রায় আড়াই মাস।