আশপাশ থেকে পুলিশ সদস্যরা ছুটে এলো। সুন্দরপুরের ওসিও পা বাড়ালো সেদিকে, তারপর কি মনে করে থমকে দাঁড়ালো। পেছনে ফিরে দেখলো এসপি মনোয়ার হোসেন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে অচেতন মেয়েটির দিকে।
“কি হইছে, স্যার?”
“এটা তো মুশকান জুবেরি না!”
একটু ভিরমি খেলো ওসি। “কি!” তারপর ঢোক গিলে বললো, “তাইলে ওইটা কে ছিলো?”
.
অধ্যায় ৪২
সুন্দরপুর থানার ওসির জিপটা এখন মহাসড়ক ধরে ছুটে চলেছে। রাস্তায় খুব কমই যানবাহন আছে, গতি বাড়াতে দ্বিতীয় চিন্তা করতে হচ্ছে না ড্রাইভারকে। যদিও পেছনের সিট থেকে আগুনে দগ্ধ মেয়েটির আর্তনাদ আর যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না এখন।
একটু আগেও ঝলসে যাওয়া মেয়েটি আর্তনাদ করতে করতে সিটের উপরে ছটফট করছিলো। তার এই যন্ত্রণাকাতর গোঙানি পুলিশের ড্রাইভারকে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে তাগিদ দিচ্ছিলো যেনো। লোকটা ভেবে পাচ্ছিলো না দগ্ধ মেয়েটির সাথে জঘন্য এই কাজটা করেছে আরেকজন নারী! সেই মহিলা আবার বেশ শিক্ষিত।
গাড়িটা যখন রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে সুন্দরপুর টাউন পার হয়ে সদর হাসপাতালের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো তখন হঠাৎ করেই কাতরানোর শব্দ থেমে যায়। ড্রাইভার হয়তো মনে করে থাকবে আহত মেয়েটি মারা গেছে, তাই উৎসুক হয়ে পেছন ফিরে যে-ই না দেখতে যাবে অমনি সে তার জীবনে সবচেয়ে বড় ভয়টি পায়। সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ছোটোবেলা থেকে শোনা সবগুলো ভুতের গল্পকে হার মানিয়ে দেবার জন্যই হয়তো বা পেছনের সিটে আগুনে পোড়া মেয়েটি তার দিকে পিস্তল তাক করে রাখে!
“রাস্তার পাশে গাড়ি থামাও!” বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে ওঠে আগুনে। ঝলসে যাওয়া মুখটি। তার উচ্চারণে গ্রামটান নেই! “একদম নড়বে না। যা বলি তাই করবে, নইলে গুলি করবো।”
মাথামুণডু কিছুই বুঝতে পারছিলো না বেচারা ড্রাইভার। হতবুদ্ধিকর এক ঘোরের মধ্যেই গাড়ির গতি কমিয়ে দেয় সে। আস্তে করে রাস্তার পাশে ওটা থামাতেই তার মনে হয় এই রাতে নির্জন রাস্তায় ভুতের খপ্পরে পড়েছে। সে। ভুতটা ভর করেছে এইমাত্র মরে যাওয়া মেয়েটির উপরে! কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছিলো না ভুতটার হাতে পিস্তল এলো কিভাবে।
পিস্তলের মুখে জিপ থেকে নেমে পড়ে সে। তারপর ভূতটার নির্দেশমতো ঘুরে দাঁড়ায় দু-হাত তুলে। কয়েক মুহূর্ত পরই শুনতে পায় গাড়িটা শব্দ করে চলে যাচ্ছে। পেছন ফিরে হতবাক হয়ে দেখতে পায় প্রচণ্ড গতিতে চলে যাচ্ছে ওটা।
রিয়ার-মিররে ড্রাইভারের হতভম্ব হওয়া চেহারাটা দেখে মুচকি হেসেছিলো মুশকান জুবেরি। আমেরিকায় গিয়ে ষোলো বছর বয়সেই ড্রাইভিং শিখেছিলো। আঠারো পেরোবার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে ক্যাম্পাসে যেতো। ড্রাইভিংয়ের নেশা আজো ছাড়তে পারে নি।
একহাতে দুইলটা ধরে অন্যহাত দিয়ে মুখের উপর থেকে রাবারের মতো শক্ত হয়ে যাওয়া ফেসিয়াল প্যাকের আস্তরণটি টেনে টেনে খুলে ফেললো। তার সুন্দর চুলগুলো কেমন কুঁকড়ে আছে, ফুলেফেঁপে রয়েছে। ভালো করে ধুলে ওগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। পিস্তলটা পাশের সিটের উপরে রেখে দিলো। জিনিসটা ছফার কাছ থেকে নিয়েছে। গায়ে। জড়ানো শাড়িটার কিছু করলো না। তার পেটে বেল্ট দিয়ে একটা ছোট্ট প্যাকেট বাঁধা আছে, ওটাতে আছে একসেট সালোয়ার-কামিজ, মোবাইলফোন আর কিছু টাকা।
বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো মুশকানের ঠোঁটে। খুব বেশি সময় পায় নি প্রস্তুতি নেবার জন্য। বিকেলের পরই সে বুঝে যায় ঐ নুরে ছফা পুলিশের লোক হতে পারে। যে-ই সেই পুলিশ নয়, অনেক ক্ষমতাধর একজন পুলিশ। বাড়ির বাইরে সাদাপোশাকে দু-জন লোকের আগমন, ওসি-এসপি-এমপি তার ফোন না ধরার একটাই মানে ছিলো তার কাছে।
কি হতে যাচ্ছে সেটা যখন বুঝতে পারলো তারপর আর বেশি সময় নষ্ট করে নি। গভীর করে দম নিয়ে নিজেকে আগে প্রসতুত করে নেয়। গ্লাসে অল্প একটু রেডওয়াইন ঢেলে শান্ত হয়ে পান করতে বসে। গ্লাসটা খালি হবার আগেই একটি পরিকল্পনা করে ফেলে সে। কি কি করতে হবে মনে মনে ঠিক করে নিয়ে দ্রুত কাজে নেমে পড়ে। তার মধ্যে হয়তো একটু অস্থিরতা ছিলো, একটু উদ্বিগ্নতাও থেকে থাকবে কিন্তু সে নিশ্চিত ছিলো তার পরিকল্পনা সফল হবে। কঠিন পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়ার মতো নার্ভ তার নেই। ওটা অনেক আগেই ভেঙেচুড়ে একদম নিঃশেষ হয়ে আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছে। তার মনে হয় না এ দুনিয়াতে এমন কোনো কঠিন। পরিস্থিতি আছে যা তাকে ভেঙে ফেলতে পারে।
প্রথমেই মিউজিক প্লেয়ারের ভয়েস রেকর্ডারে একটি আর্তচিৎকার রেকর্ড করে। বেশি না, পর পর দু-বারই যথেষ্ট ছিলো। ফাইলটা কপি করে নেয় আরো কয়েকবার। ওটা শেষ করে দীর্ঘদিন ধরে আগলে রাখা পেপার ক্লিপিংসের অ্যালবামটা নিয়ে কাজে নেমে পড়ে।
আরব্য-রজনীর সেই কাহিনীর মতোই নুরে ছফা পেপার-ক্লিপিংসের অ্যালবামের পৃষ্ঠা ওল্টানোর জন্য ডানহাতের তর্জনী বার বার জিভে লাগিয়ে ভিজিয়ে নিয়েছে আর নিজের অজ্ঞাতসারে শরীরে প্রবেশ করিয়েছে নার্ভ সিস্টেম বিকল করে দেয়ার মতো শক্তিশালী একটি ড্রাগস। একটু শক্তিশালী ডোজ ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। তার হিসেবে ছিলো তর্জনীতে লেগে থাকা ড্রাগস যেনো কমপক্ষে তিনবার জিভে স্পর্শ করতেই কাজ শুরু করে। বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো ব্যাপারটা, কিছুটা নাটকীয়ও।