“ও নিজেও মরছে, সবাইরে মারছে!” মেইনগেটের সামনে এসে পেছন ফিরে অদৃশ্য কারোর উদ্দেশ্যে বললো মেয়েটি। যে হাতটা মুক্ত সেটা উদভ্রান্তের মতো নাড়ছে। “আল্লাগো! আমার সব শ্যাষ কইরা দিছে?”
এসপির চোখমুখ তিক্ততায় কুচকে গেলো। অভাবে পড়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে এইসব মেয়ে, আর তাদের সাথে শেষ পর্যন্ত কী জঘন্য আচরণটাই করা হয়! মেয়েটা যেভাবে পুড়েছে তাতে মনে হচ্ছে না সে বাঁচতে পারবে।
কিছুক্ষণ পরই ওসিকে সঙ্গে নিয়ে এসআই আনোয়ার ফিরে এলো বাড়ির ভেতরে।
“স্যার, থানার জিপে কইরা মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠায়া দিছি,” ওসি রিপোর্ট করলো।
মাথা নেড়ে সায় দিলো এসপি। “এখন কি করবো, স্যার?” ওসি কিছু বুঝতে না পেরে বললো।
“আমিও তো কিছুই বুঝতে পারতাছি না, নিজের অপারগতা না দেখিয়ে পারলো না মনোয়ার হোসেন।
পুরো বাড়িটা এখন নরককুণ্ড হয়ে জ্বলছে। রাতের আকাশ লালচে আলোয় আলোকিত। রীতিমতো গমগম শব্দ করে সবকিছু গিলে খাচ্ছে। আগুনের শিখাগুলো। যতোই খাচ্ছে ততোই যেনো বাড়ন্ত হচ্ছে।
“বাড়ির ভিতরে তো যাওন যাইবো না…সবখানে আগুন, বাড়ির দিকে চেয়ে বললো সুন্দরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো এসপি৷ “নুরে ছফার কী হলো কে জানে!”
মুখ ফুটে কিছু না বললেও সুন্দরপুর থানার ওসি জানে ডিবির ঐ ইনভেস্টিগেটরের পরিণতিটা। মুশকান জুবেরি নিজেও বেঁচে নেই। মহিলা শেষপর্যন্ত আত্মঘাতিনী হয়েছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেচারা নুরে ছফা সম্ভবত ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি এই মহিলা এরকম কিছু করতে পারে।
এতোক্ষণে আশেপাশের অনেক উৎসুক মানুষ মেইনগেটের সামনে এসে জড়ো হয়ে দেখছে আগুন কিভাবে জ্বলন্ত চিতা বানিয়ে ফেলেছে জমিদার বাড়িটাকে।
ওসি পেছন ফিরে দেখলো মেইনগেটের সামনে জড়ো হওয়া মানুষজন আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ছে। “অ্যাই! বাড়ির বাইরে যাও! কেউ বাড়িতে ঢুকবে না!” চিৎকার করে বললো সে। “কেউ না!”
গ্রামের লোকজন কয়েক পা পিছু হটে গেলেও তাদের আগ্রহ মোটেও পিছটান দিলো না।
ফোনের রিং বেজে উঠলে এসপি মনোয়ার হোসেন চমকে বাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। “হ্যালো…” ওপাশ থেকে ছফার সহকারি জাওয়াদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা শুনতে পেলো সে। “হূম…” চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “…আমরা সবাই সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে চলে এসেছি… বাড়িটা এখন আগুনে জ্বলছে, সম্ভবত মুশকান জুবেরি আর নুরে ছফা বাড়ির ভেতরেই আছে…” আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “…ভেতরে যদি থেকে থাকে তাহলে মনে হয় না, কেউ বেঁচে আছে।”
এমন সময় একটা হৈহল্লা শুনে কানে ফোন চেপে রেখেই সেদিকে তাকালো এসপি। বোবা ছেলেটা দৌড়ে চলে যাচ্ছে বাড়িটার দিকে। তাকে যারা ধরে রেখেছিলো তারা কিছুটা সামনে বেড়েই থমকে দাঁড়ালো। কোন্ ফাঁকে যে তাদের হাত থেকে ছুটে গেছে টেরই পায় নি।
দারোয়ান ছেলেটি নীচতলার সদর-দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে। যেনো জ্বলন্ত নরকের ভেতর ঢুকে গেলো সে।
“পাগল নাকি!” ওসি আবারো কথাটা বললো।
এসপি মনোয়ার হোসেন কানে ফোনটা চেপেই ওসির পাশে এসে দাঁড়ালো বোবার এমন আচরণে সেও অবাক। “…ঐ বাড়ির দারোয়ান… বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে…হুম…মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়।” ওপাশে জাওয়াদের কথা শুনে আক্ষেপে মাথা দোলালো এসপি। “ধারেকাছে কোথাও ফায়ার সার্ভিস নেই..তারপরও আমি খবর দিয়েছি ওদের…না, না…দোতলা থেকে আগুন লেগেছে…যেভাবে জ্বলছে বাইরে থেকে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করলেও কাজ হতো না।” আরো কিছুক্ষণ কথা শুনে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ফেললো সে।
“বাড়িটা ভাইঙ্গা পড়তে পারে, স্যার,” ওসি বললো মনোয়ার হোসেনের দিকে তাকিয়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেটে ফোনটা রেখে দিলো ভদ্রলোক। আগুনের সর্বগ্রাসি রূপ দেখে তার মনে হচ্ছে নুরে ছফার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
বাড়িটার সামনে থেকে সবাই একটু একটু করে পিছিয়ে গেলো। আগুনের উত্তাপ ক্রমশ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভবনের সামনে পার্ক করে রাখা প্রাইভেটকারটি কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের গ্রামে চলে যাবে। এসপি মনোয়ার হোসেন আগুনের উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।
“বোবা পোলাটা মনে হয় আটকা পইড়া গেছে,” ওসি বললো।
মাথা নেড়ে সায় দিলো এসপি। ছেলেটা কী মনে করে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো কে জানে। ভেতরে তার কোনো মূল্যবান জিনিস ছিলো? নাকি মুশকান জুবেরিকে উদ্ধার করার জন্য?
ঠিক তখনই জ্বলতে থাকা বাড়ির নীচতলা থেকে গোঙানি শোনা গেলো। কণ্ঠটা নিশ্চয় কোনো পুরুষ মানুষের। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কপাট খুলে রাখা সদর-দরজা দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে এলো বোবা। আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য গায়ে মোটা একটা কম্বল জড়িয়ে রেখেছে সে। বোঝা যাচ্ছে তার কোলে অচেতন এক নারী! বোবা ছেলেটি বাড়ির সামনে লনের উপর মেয়েটিকে নামিয়ে রেখে হাত নেড়ে গোঙাতে গোঙাতে কী সব বলতে লাগলো। মেয়েটার শরীর অনেকটাই নগ্ন, শুধুমাত্র পেটিকোট আর ব্লাউজ আছে গায়ে। তবে তার শরীরে আগুনে পোড়ার কোনো চিহ্ন নেই!