“আরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দিন, জলদি!” চিৎকার করে বললো। এসপি।
ওসি থতমত খেয়ে মোবাইলফোনটা বের করলো। “ওরা আসতে আসতে তো পুরা বাড়ি পুইড়া ছাই হইয়া যাইবো, স্যার,” নাম্বারটা ডায়াল করে কানে চাপালো ওসি।
এসপিও এটা জানে। আশেপাশে সবচেয়ে নিকটে যে ফায়ার সার্ভিসের ডিপো আছে সেটা প্রায় ত্রিশমাইল দূরে। কিন্তু দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে তাদের খবর দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। মনোয়ার হোসেন চোখ কুচকে তাকিয়ে রইলো বাড়িটার দিকে। নুরে ছফার পরিণতি নিয়ে সে ভীষণ চিন্তিত। এসআই আনোয়ার যে বোকার মতো বাড়িটার সদর-দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা দেখে আরো হতাশ হলো। সম্ভবত উপরতলায় নুরে ছফা আছে, আর তার পরিণতিটা কি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই আগুন নেভানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়লেও লাভ হবে না, তাতে কেবল হতাহতের সংখ্যা বাড়বে।
একটা গোঙানির শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালো এসপি আর ওসি। মেইনগেটের কাছে বোবা দারোয়ান ছোটার জন্য হাসফাস করছে। তাকে দু দিক থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে দু-জন কনস্টেবল।
“কি হইছে,” ফায়ার সার্ভিসকে খবরটা দিয়ে ফোন নামিয়ে বললো ওসি।
“স্যার, হে তো বাড়ির দিকে ছুঁইটা যাইতে চাইতাছে,” একজন কনস্টেবল জবাব দিলো। বোবাকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে তারা।
“পাগল হইছে নি…ও কি দেখতাছে না বাড়িটাতে আগুন লাগছে.” বিরক্তমুখে বলে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো সে। “আপনে তো কইলেন বোবা, এখন তো দেখতাছি চোখেও দেখে না। পুরাই আন্ধা!” এসপির দিকে ফিরে বললো ওসি।
ঠিক এ-সময় নারীকণ্ঠের একটি চিৎকার ভেসে এলো। “মাগো লাগে; বাবাগো! বাঁচাও! বাঁচাও!” তবে সেটা দোতলা থেকে নয়, নীচতলা থেকে! এবারের চিৎকারটাও ভিন্ন রকম!
এমন সময় পেছন-বাড়ি থেকে দৌড়ে এলো দু-জন কনস্টেবল। “সব গেট বন্ধ! বাড়ির পেছনে কেউ নাই!” তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে উঠলো।
“স্যার!” সদর দরজার সামনে থেকে পেছন ফিরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো এসআই আনোয়ার। “নীচতলায় কেউ আছে?”
এসপি আর ওসি নড়েচড়ে উঠলো।
“ওরে বলো দরজা ভিতর থেইকা খুইলা বাইর হইয়া আসতে!” ঝপটপ বললো ওসি।
দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিয়েই আনোয়ার বলে উঠলো, “ভিতর থেইকা দরজা খুইলা বাইর হন…জলদি!”।
নারীকন্ঠের চিৎকারটা বিরামহীনভাবেই হচ্ছে। যেনো উন্মাদ হয়ে গেছে কেউ। থামছেই না। কয়েক সেকেন্ড পরই ভেতর থেকে দরজাটা খুলে গেলে বীভৎস দৃশ্য দেখা গেলো। গায়ে জবুথুবু করে শাড়ি জড়িয়ে এক তরুণী দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। তার শাড়ির আঁচলের অগ্রভাগে এখনও আগুন জ্বলছে। তার হাত-মুখ-পা ঝলসে গেছে আগুনে। শাড়িটাও পুড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। মাথার চুলগুলো আগুনের লেলিহান শিখার স্পর্শে এসে কেমন কুঁকড়ে গেছে। তবে সবচাইতে ভয়ঙ্করভাবে ঝলসে গেছে মেয়েটির মুখ। সেটা দেখে চেনার উপায় নেই। মাংস আর পোড়া চামড়া লেপ্টে আছে যেনো মুখে! সম্ভবত মেয়েটার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। মাথার চুল আর সারামুখ রক্তে ভিজে একাকার।
“আমারে বাঁচান! আমারে বাঁচান! ঐ ডাইনি আমারে শ্যাষ কইরা দিছে!” মেয়েটি উদভ্রান্তের মতো বলতে লাগলো। আমার সারাশরীর জ্বলতাছে! মাগো-বাবাগো!” গগনবিদারি আহাজারি করতে লাগলো সে।
এসআই আনোয়ার মেয়েটার একহাত ধরে তাকে কিছু বলতে যাবে অমনি মেইনগেট থেকে তীব্র একটা গোঙানি দিয়ে মেয়েটার দিকে ছুটে আসতে লাগলো বোবা দারোয়ান। দু-জন কনস্টেবল তাকে আর ধরে রাখতে পারে নি।
এসপি মনোয়ার হোসেন আর ওসি ঝটপট ঘুরে দাঁড়ালো। ওসি দু-হাতে বোবা ছেলেটাকে জাপটে ধরে ফেললেও তাকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কনস্টেবল দু-জন ছুটে এসে বোবাকে জাপটে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিলো।
“এই শালার কি মাথা খারাপ হইছে?” ওসি অবাক হয়ে বললো।
“ওরে আমর কাছে আইতে দিয়েন না! আমারে হাসপাতালে নিয়া যান। আল্লার দোহাই লাগে, আমারে হাসপাতালে নিয়া যান?” চিৎকার করে বলতে লাগলো ঝলসে যাওয়া তরুণী। “আমারে বাঁচান! আমারে বাঁচান!”
আগুনে পোড়া মেয়েটির আর্তনাদ উপস্থিত সবাইকে স্পর্শ করলো।
“মেয়েটাকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যান। দেরি করলে বাঁচবে না!” মনোয়ার হোসেন আদেশের সুরে বললো ওসিকে।
“জি, স্যার,” ওসি দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আনোয়ারের উদ্দেশ্যে জোরে বললো, “ওরে বাইরে নিয়া আসো। এক্ষুণি হাসপাতালে পাঠাইতে হইবো।” কথাটা বলেই সে মেইনগেটের দিকে পা বাড়ালো।
আনোয়ার মেয়েটার একহাত ধরে তাকে মেইনগেটের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ঝলসে যাওয়া তরুণীকে দেখে মনে হচ্ছে সে চোখে কিছু। দেখছে না। এসপি জানে, এই বাড়ির কাজের মেয়েটি রাতকানা রোগে ভুগছে। বেচারি গরীবঘরের মেয়েটির জন্য তার খুব মায়া হলো। “ঐ ডাইনি সব জ্বালায়া দিছে! সব শ্যাষ কইরা দিছে! এক বেটারেও মারছে! আমারেও পুড়াইয়া মারতে চাইছিলো!” মেইনগেটের দিকে যেতে যেতে বললো আগুনে পুড়ে যাওয়া মেয়েটি।
বোবা ইয়াকুব মেয়েটাকে চলে যেতে দেখে পাগলের মতো ছটফট করছে কিনতু তার উপরে চেপে বসা দু-জন কনস্টেবলের হাত থেকে ছাড়াতে পারছে নানিজেকে জবাই করা পশুর মতো গোঙানি দিচ্ছে মুখ দিয়ে।