“কি?” আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো ওসি।
“জলদি বাড়িতে ঢোকো তোমরা!” চিৎকার করে বললো এসপি মনোয়ার।
এসআই আবারো দৌড়ে গেলো দেয়ালের দিকে।
এসপি আর ওসি কয়েক পা পেছনে যেতেই দেখতে পেলো গেটের পেছন থেকে লালচে আলো আর ধোঁয়া উঠছে। সম্ভবত বাড়িটার দোতলায় আগুন লেগেছে। আরেকটু পিছিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো তাদের আন্দাজ পুরোপুরি সঠিক।
“ঘটনা-” ওসি কথাটা বলতে পারলো না, তার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে গগনবিদারি চিৎকার ভেসে এলো। আর সেই কণ্ঠটা একজন নারীর!
» ৯. বোবা ইয়াকুব
অধ্যায় ৪১
বোবা ইয়াকুব মেইনগেটের পাশে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা বাড়ির দিকে মুখ করে। মূক-বধির হিসেবে কোনো শব্দ তার কানে পৌঁছায় না বলে নারীকন্ঠের চিৎকারটা সে শুনতে পায় নি, চিৎকারটী কার সেটা বোঝা তো দরে কথা। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে দোতলায়!
একটু আগে ম্যাডাম নীচতলার জানালার সামনে এসে তাকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সে যেনো কোনোভাবেই গেটটা খুলে না দেয়। এরপর গেটের বাইরে কিছু লোকজন এসে গেট খোলার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। আর পুরো দৃশ্যটা সে দেখেছে গেটের মধ্যে একটা ছোট্ট ফুটো দিয়ে। ক্ষিপ্ত হয়ে এক লোক গেটে লাথিও মেরেছে, তারপরও সে গেটটা খুলে দেয় নি। একটু আগে গেটের বাইরে পুলিশের দুটো গাড়ি এসে থেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াকুব বুঝতে পেরেছিলো, ঐ ফালু ছেলেটাকে এখানে ঢুকতে না দিলে আজ এতোকিছু হতো না। সাফিনার ভাই ছাড়াও ফালু তার বনধুও বটে, তাই ইয়াকুব তাকে লুকিয়ে থাকার জন্য ম্যাডামের অগোচরে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে। ওকে খুঁজতে যে পুলিশ চলে আসবে সেটা জানলে এই কাজ কখনওই করতো না।
তার এই আক্ষেপটার স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। তারপরই দেখতে পায় দোতলার একটি ঘরে আগুন লেগে গেছে। নিমেষে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়লো পাশের ঘরে। দেখতে দেখতে পুরো দোতলায়। বাড়ির দিকে ছুটে গেছিলো সে, কিন্তু সবগুলো দরজাই বন্ধ। কয়েকবার দরজা-জানালায় ধাক্কা মেরে কোনো সাড়া পায় নি। ঘটনা কি কিছুই বুঝতে না পেরে আবারো মেইনগেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোন ধারণাই নেই একটি নারীকন্ঠের চিৎকার প্রকম্পিত করেছে চারপাশ।
হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে ডানদিকে কিছু একটা দেখতে পেয়ে চমকে তাকালো ইয়াকুব। দু-জন লোক পিস্তল হাতে ছুটে আসছে তার দিকে। আরেকজন সাদাপোশাকের লোক তখনও দেয়ালের উপরে। দু-জনের মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা একজন আর অন্যজন সাদাপোশাকে। ইয়াকুব দু হাত তুলে কিছু বলার চেষ্টা করলেও শুধু গোঙানির মতো শব্দ করতে পারলো। তারপরই দু-জন মানুষ পিস্তল তাক করে তাকে মাটিতে বসে পড়ার জন্য হুকুম করলো। ওরা নিশ্চয়ই চিৎকার করে কিছু বলছে, কিন্তু বোবা শুধু ওদের ক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি দেখতে পেলো।
মাথার উপরে হাত তুলে হাটু গেড়ে বসে পড়লো দারোয়ান। পুলিশের পোশাক পরা একজন চিৎকার করে হাত নেড়ে চাবি চাইলে তার কাছে। দেরি করে কোমর থেকে চাবির গোছাটা বের করে পুলিশের হাতে দিয়ে দিলো সে। লোকটা দৌড়ে চলে গেলো মেইনগেটের দিকে। দ্রুত তালা খুলে টেনে গেটটা খুলে দিলো।
এসপি মনোয়ার, ওসি আর দু-জন কনস্টেবল ঠুরমুর করে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা দোতলা বাড়িটির দিকে তাকালো সবাই। বাড়ির সামনে যে লন আছে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো তারা, বুঝতে পারলো না কি করবে।
“স্যার, নীচতলায় এখনও আগুন ছড়ায়া পড়ে নাই,” কথাটা বললো আনোয়ার। “ভিতরে গিয়া দেখুম?”
“জলদি করো, তাড়া দিয়ে বললো এসপি।
এসআই আনোয়ার লনটা পেরিয়ে গেলো বড় বড় পা ফেলে। তার পেছন পেছন ছুটলো ডিউটিতে থাকা দু-জন পুলিশ। তাদের সবার হাতে পিস্তল। আনোয়ার মূল ভবনের গেটটা ধাক্কা মেরে বুঝতে পারলো ওটা ভেতর থেকে বন্ধ। পাশের জানালার কপাটে ধাক্কা মারলো, ওটাও বন্ধ। এবার সে দরজায় লাথি মারলো কিন্তু কাজ হলো না। সেগুন কাঠের ভারি দরজা, কয়েকজন মানুষের পক্ষেও লাথি মেরে ভাঙা সম্ভব নয়।
আনোয়ার সাদাপোশাকের দু-জনকে বললো বাড়িটার পেছনে চলে যেতে, ওখানে কোনো দরজা খোলা আছে কিনা দেখতে। সঙ্গে সঙ্গে দু-জন পুলিশ চলে গেলো পেছন-বাড়িতে। আনোয়ার যখন আবারো লাথি মারতে যাবে দরজায় তখনই সেই চিৎকারটা ফিরে এলো আবার।
নারীকণ্ঠের আর্তনাদ।
এসপি মনোয়ার হোসেন বুঝতে পারলো এটা কার কণ্ঠ।
মুশকান জুবেরি!
“স্যার, কে চিল্লাইতাছে?” ওসি জানতে চাইলো তার কাছে।
“জানি না,” মিথ্যে বললো সে।
“বাড়িতে আগুন দিলো কে?” বিড়বিড় করে বললো ওসি।
“হায় আল্লাহ, নুরে ছফা কোথায়?” এসপির মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো কথাটা।
ওসি কোনো জবাব দিতে না পেরে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপরই গেটের দিকে নজর যেতে বলে উঠলো, “ঐ ব্যাটা দারোয়ানরে জিজ্ঞেস করি?”
“ও বোবা…কথা বলতে পারে না।”
এসপির দিকে ভুরু কুচকে তাকালো সুন্দরপুরের ওসি। মুশকান জুবেরির সাথে যে এসপির দারুণ সখ্যতা সেটা তারা ভালো করেই জানে। এখন দেখতে পাচ্ছে, এই বাড়ির অনেক খবরও এসপির জানা।
নারীকণ্ঠটা আবারো চিৎকার দিয়ে মাঝপথে থেমে গেলো। ভয়ের সাথেই তারা দেখতে পেলো দোতলার আগুন নীচতলায় ছড়িয়ে পড়ছে। বন্ধ জানালাগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আগুনের শিখা।