ফালু দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
“তোমার ঘটনা আমি শুনেছি,” বললো মুশকান। কয়েক পা এগিয়ে গেলো সে। “ঐ ইনফর্মারকে কেন মেরেছো?”
কাচুমাচু খেলে গোরখোদক। “ও…ও সব দেইখা ফালাইছে…জাইনা গেছে!”
ভুরু কুচকে ফেললো মুশকান। “কি জেনে গেছে?”
গাল চুলকালো ফালু। “আমি যে কঙ্কাল চুরি কইরা বেচতাম…”
মুশকান জুবেরি আর কিছু বললো না। এই গোরখোদক ছেলেটাকে সুন্দরপুরের অনেক মানুষ মান্য করে, সমীহ করে। তাদের ধারণা ছেলেটার মধ্যে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে, আর সেই ক্ষমতাবলে কেউ মারা যাবার আগেই সে বুঝে যায়, আগাম কবর খুরে রাখে। এ কথাটা যখন সে প্রথম শুনলো ফালুর সৎবোন সাফিনার কাছ থেকে তখন মনে মনে খুব হেসেছিলো। সে জানতো ফালুর এরকম কোনো ক্ষমতা নেই, তবে নিশ্চয় কোনো গোমড় আছে। সব মানুষেরই তা থাকে। এখন দেখছে, সুন্দরপুরের কামেল গোরখোদক আসলে নরকঙ্কাল চুরি করে বিক্রি করে!
“যাহোক, বাড়ির বাইরে পুলিশ আছে। তুমি এখানে থাকলে ধরা পড়ে। যাবে।”
মুশকানের কথা শুনে ঢোক গিললো পলাতক গোরখোদক।
“তবে আমি তোমাকে পালাতে সাহায্য করবো যদি আমার কথামতো কাজ করো।”
“বলেন, কি করতে হইবো,” ফালু বললো।
*
জমিদার বাড়ির সামনে সাদা পোশাকের যে দু-জন পুলিশ সদস্য ডিউটিতে ছিলো তারা গেটের সামনে এসে জোরে জোরে আঘাত করছে কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটু আগে তাদেরকে থানা থেকে ফোন করে জানানো হয় ঐ বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য। নুরে ছফা নামে ডিবির যে অফিসার ওখানে ঢুকেছে সে নাকি ভীষণ বিপদে পড়েছে। তাকে ফোন করলেও সে ফোন ধরছে না। ধরলেও কোনো রকম সাড়া-শব্দ করছে না। তাদেরকে আরো বলা হয়েছে, থানা থেকে একটা টিম রওনা দিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা চলে আসবে এখানে।
“ওই ব্যাটা দারোয়ানের বাচ্চা! গেট খোল!” তাদের মধ্যে লম্বা করে যে লোকটা আছে সে চেঁচিয়ে উঠলো। আচার-আচরণে সে সবসময়ই আগ্রাসী। “ওই মাদারচোদ্দ! গেট খুলবি নাকি ভাইঙ্গা ঢুকুম?”
তারপরও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সঙ্গির দিকে তাকালো। “আমি কি দেয়াল টপকাইয়া ভেতরে ঢুকবো?”
মাথা চুলকালো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের একটি দল চলে আসবে। তাদের জন্য অপেক্ষা না করে ভেতরে ঢোকাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। “ফোর্স তো চইলা আসবো…ওরা আসুক, তারপর যা করার করন যাইবো কি কও?”
অন্য সঙ্গিটি কাঁধ তুললো কেবল। “হ, তাই করো।”
এমন সময় ওপাশ থেকে খুট করে শব্দ শুনতে পেয়ে তারা দুজনেই সতর্ক হয়ে উঠলো।
“ঐ দারোয়ান মনে হয় গেটের পেছনেই আছে,” আগ্রাসী পুলিশ বললো তার সঙ্গিকে। “ওই শুয়োরেরবাচ্চা! আমরা পুলিশ….গেট খোল কইতাছি!” তারপরও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পা দিয়ে জোরে জোরে লাথি মারলো গেটে। এমন সময় তার কাঁধে সঙ্গির হাত পড়তেই লাথি মারা থামিয়ে। দিলো।
“ফোর্স আসতাছে,” অন্যজন বললো তাকে।
এবার মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার শব্দ শুনতে পেলো তারা। গাড়িগুলো আসার অপেক্ষায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো দু-জনে।
একটা নয়, দুটো গাড়ি এগিয়ে আসছে জমিদার বাড়ির দিকে। হেডলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো মেইনগেটের সামনের অংশটা।
প্রথমে একটা জিপ এসে থামলো গেটের সামনে। সুন্দরপুর থানার ওসি, এসআই আনোয়ারসহ আরো তিনজন কনস্টেবল নেমে এলো সেটা থেকে। তাদের স্যালুট দিয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি আরেকটি জিপ এসে থামলো, ওসি আর এসআই সেই গাড়ির সামনে ছুটে গেলে সঙ্গে সঙ্গে। জিপ থেকে নেমে এলো এসপি মনোয়ার হোসেন।
“এখনও ভেতরে ঢোকেন নি?” ওসির উদ্দেশ্যে বললো সে।
“স্যার, আমি তো জাস্ট এলাম,” ব্যাখ্যা করলো সুন্দরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
“যে দু-জন ডিউটিতে ছিলো ওরা কি করেছে?” “স্যার,” পেছন থেকে সামনে চলে এলো ডিউটিতে থাকা দু-জন সাদা পোশাকের পুলিশ। “ভিতর থেইকা গেট বন্ধ কইরা রাখছে। অনেক ধাক্কাইছি-”
“আরে এতো কথা বলছো কেন? গেটটা যেভাবে পারো খোলার ব্যবস্থা করো!” চিৎকার করে বললো এসপি।
পড়িমরি করে ডিউটিতে থাকা দু-জন আবার গেটের সামনে দৌড়ে গেলো। ওসি পেছনে ফিরে তার সঙ্গে আসা তিনজন কনস্টেবলকে ইশারা করলো ওদের সাথে যোগ দিতে।
“স্যার, গেটটা যদি খুইলা না দেয় তাইলে কিন্তু ভাইঙ্গা ঢুইকা যাবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো এসপি। “যা করার জলদি করেন।”
ওসিও আর কোনো কথা না বলে গেটের কাছে চলে গেলো, তার পেছনে পেছনে এসআই আনোয়ার।
“এই! গেট খোল!” ডিউটিতে থাকা একজন হাক দিলো। “স্যার,” পেছন ফিরে তাকালো সে। “মনে হয় না ভিতর থেইকা গেট খুইলা দিবো।”
“তাইলে দেয়াল টপকাইয়া ভিতরে ঢোকো।”
“আমার সাথে আসো,” ঝটপট বলে উঠলো এসআই আনোয়ার। ডিউটিতে থাকা দু-জন পুলিশকে নিয়ে চলে গেলো গেটের ডানপাশের দেয়ালের দিকে।
“ভেতর থেকে কিছু শোনা গেছে?” এসপি বলে উঠলো ওসির পেছনে এসে।
“না, স্যার,” পেছন ফিরে বললো ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। “পুরা বাড়িই সুনসান। ওরা আমারে একটু পর পর জানাইছে সব। ছফাস্যার ভিতরে ঢুকার পর তেমন কিছুই ঘটে নাই।”
এসপি চিন্তিতমুখে কিছু বলতে যাবে অমনি “আগুন-আগুন!” বলে একটা চিৎকার হলো। তাদের কাছে দৌড়ে এলো আনোয়ার।
“স্যার, বাড়িটাতে আগুন লাগছে!”