কেএসকে কিছুই বুঝতে পারলো না। “ইট ডাসেন্ট মেক সেন্স!” বিড়বিড় করে বললো।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “ইট রিয়েলি ডাসেন্ট মেক সেন্স অ্যাট অল।”
“মানুষের শরীরের কোন অংশটা খাইতো মুশকান?”
কেএসকের দিকে তাকালেন ডাক্তার। বুঝতে পারছেন ভদ্রলোকের আগ্রহের পারদ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। “ও সেটা কখনও কাউকে বলে নি।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, “সম্ভবত এই জীবনে কখনও কাউকে বলবেও না।”
মি. খান স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
“এই সিক্রেটটা সে কি কারণে কারোর সাথে শেয়ার করে না, জানেন?”
কেএসকে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “একটা মারাত্মক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিবো। সভ্যতা আর সভ্য থাকবে না। মানুষ হইয়া যাইবো অসভ্য। পশু। ঠিক যেমনটা ছিলো আদিমযুগে…” একটু থেমে আবার বললো, “…ঠিক আদিমও না..তার চায়াও বর্বর। একে অন্যেরে খাওনের জন্য…” আর বলতে পারলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “সবাই চিরযৌবন। চায়!”
ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কতোগুলো দৃশ্য ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। মৃত্যুভয়ে কাতর একজন মানুষ তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠবনধুর কাছে নিজের গোপনভীতিটার কথা জানালো একদিন। ক্রমশ বার্ধক্যের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর হিমশীতল গহ্বরের দিকে। কিন্তু সে বাঁচতে চায় আরো অনেক বছর। এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বড় ভয়। আজকাল মৃত্যুচিন্তা তাকে দিন-রাত ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে।
সব শুনে মুশকান পরম মমতায় বন্ধুর হাত দুটো ধরে সহমর্মিতা জানালো! “এই পৃথিবীতে আমার বন্ধু বলতে শুধু তুমি সেই তুমি চলে গেলে যে আমি বড় একা হয়ে যাবো!”
আলো-আঁধারির একটি ডাইনিংরুম। বিশাল একটি টেবিল। দু-জন মানুষ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু জানতে চাইছে না। কেউ কিছু বলছেও না। যেনো নীরবতার এক অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ তারা। এরপর থেকে নির্জন জমিদারবাড়িটি হয়ে উঠলো মৃত্যুভয়ে পর্যদস্ত বৃদ্ধমানুষটির নিয়মিত গন্তব্য। আর আলো-আঁধারির ডাইনিংরুমটি তার গোপন তীর্থস্থান।
অনেকক্ষণ পর চোখ খুললেন ডাক্তার। দেখতে পেলেন কেএস খান গভীর মনোযোগের সাথে চেয়ে আছে তার দিকে।
“মানুষ সব সময়ই চিরযৌবন লাভের আশায় মরিয়া…” ধীরকণ্ঠে বললেন তিনি। “সভ্যতার শুরু থেকে সে এই চেষ্টাটা করে আসছে, এখনও এ নিয়ে বিরাট গবেষণা করছে হাজার-হাজার বিজ্ঞানী কিনতু তারা কেউই জানে না, মানুষের শরীরের ভেতরেই লুকিয়ে আছে চিরযৌবন লাভের সেই অমৃত!”
হতবুদ্ধির দেখালো কেএস খানকে।
“ ডিজাইনড বাই মাদার-ন্যাচার,” গম্ভীর মুখে বললেন ডাক্তার। আর এমনভাবে এটা করা হয়েছে, যৌবন দীর্ঘায়িত করতে চাইলে পুরো হিউম্যান রেইসটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। একটা বিশৃঙ্খলার জন্ম। দেবে।” কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বললেন তিনি, “মুশকান এটা ভালো করেই জানে।”
অবিশ্বাস্য শোনালেও কেএসকে বোঝার চেষ্টা করলো। মানুষের শরীরের ভেতরেই জীবনরক্ষাকারী উপাদান রয়েছে, আর সেটা প্রমাণিত। বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট থেকে শুরু করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, এমনকি রক্ত-অন্য মানুষের জীবন রক্ষা করে থাকে। হয়তো চিরযৌবন লাভের উপাদানও মানুষ নিজের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। কে জানে!
“ডাক্তার?” অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো সে।
একটু চমকে তাকালেন আসকার ইবনে সায়িদ।
“আন্দিজের পরও কি মুশকান জুবেরি…?”
কথাটা শেষ করতে না পারলেও সাবেক ইনভেস্টিগেটরের প্রশ্নটা কি বুঝতে পারলেন তিনি।
“তাইলে কি ঐ পাঁচজন মানুষরে…?”
মাথা নীচু করে ফেললেন ভদ্রলোক। বাম-হাত দিয়ে কপালটা আর্ততা করে ঘষতে লাগলেন তিনি। “এটা আমি জানি না। শুধু জানি, মানুষের ওই বিশেষ প্রত্যঙ্গটির প্রতি ও অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়েছে। এটা যে ওকে যৌবন। ধরে রাখতে সাহায্য করছে সেটা তো প্রমাণিত…অন্তত মুশকানের কোনো সন্দেহ নেই এতো”।
কেএস খানের কপালে ভাঁজ পড়লো। সভ্যতার ইতিহাসে এরকম ঘটনা প্রচুর আছে। ক্যানিবালিজম এক ধরণের বিকৃত-নেশা। মানসিক সমস্যাও বটে। হয়তো এ-কারণেই কিছু অসভ্য জাতি ছাড়াও সভ্যজগতের অনেকেই সঙ্গোপনে এটার চর্চা করে থাকে। কদিন আগেও পাকিস্তানে দু ভাইকে কবর থেকে লাশ তুলে রান্না করে খেয়ে ফেলার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। সত্তুরের দশকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্তানের নরমাংসভোজি জলিল বেশ আলোচনায় চলে এসেছিলো। লাশের কলিজা খাওয়া ছিলো তার নেশা। এরকম অনেক ঘটনার কথা সে জানে। প্রায় সব দেশেই আছে এমন। কিছু মানুষ।
“আন্দিজে আটকা পড়ার সময় তারা সবাই যখন দু-মাসের মতো নরমাংস খেতে বাধ্য হয়েছিলো তখন কিন্তু মুশকান এটা বুঝতে পারে নি। মানে, চিরযৌবন লাভের কথা বলছি। ঐ অঙ্গটি খাওয়ার পর দারুণ এনার্জি পেয়েছিলো সে। প্রচণ্ড শীত আর কষ্টের মধ্যে তাকে এক ধরণের প্রশান্তি দিয়েছিলো। ও আমাকে বলেছে, ওটা খাওয়ার পর নাকি তার নার্ভ খুব শক্ত হয়ে যায়। একটু থামলেন ডাক্তার। “তবে উদ্ধার পাবার অনেক পরে সে। আবিষ্কার করে তার মধ্যে একটি পরিবর্তনও ঘটে গেছে।”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো কেএসকে। “পরিবর্তন?”
“কোনো পরিবর্তন না হওয়া!”
“দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তার মধ্যে যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা খুবই কম। বলতে পারেন, তার বেলায় ওটা খুব ধীরগতির হয়ে গেছে। চল্লিশটি বসন্তের পরিবর্তে মাত্র সাত-আটটি বসন্তের পরিবর্তন হয়েছে তার শরীরে!” একটু থেমে আবার বললেন, “যে ডাক্তার জয়েন করেছিলো আমাদের হাসপাতালে সেও প্রথমে মুশকানের পেছনে লাগলো এই সিক্রেটটা জানার জন্য। কিন্তু মুশকান যখন কিছু জানালো না তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে তার আন্দিজের ঘটনাটা বলে দিলো হাসপাতালের কয়েকজনকে। সেইসাথে আরো বলতে লাগলো, মুশকান এখনও সুযোগ পেলে মানুষের মাংস খায়। সে মানুষখেকো।”