ছফা বহুকষ্টে মুখ খুলতে পারলো কিন্তু জান্তব গোঙানি ছাড়া কোনো শব্দ বের করতে ব্যর্থ হলো আরেকবার।
“প্ৰচুর মজার মজার খাবার রান্না করলাম। রাতে ডাইনিং টেবিলে ক্যান্ডেল-লাইট জ্বালিয়ে সেগুলো পরিবেশন করলাম সুন্দর করে, তারপর প্ল্যানচেট করে ডেকে আনতে চাইলাম আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “কিন্তু উনি এলেন না!” সত্যি সত্যি উদাস হয়ে গেলো মুশকান। “কেন এলেন না, জানো?”
ছফার দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।
বাঁকাহাসি দেখা গেলো রহস্যময়ীর ঠোঁটে। “আমি উনার সম্পর্কে এতোকিছু জানতাম আর এটা জানতাম না, উনি খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে একদম অমনোযোগী ছিলেন। উনি মনে করতেন খাওয়া-দাওয়া করা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। তারচেয়ে বড় কথা, আমার বানানো খাবারগুলো প্রায় সবই ছিলো নন-ভেজ।” মাথা দোলালো ডাক্তার মুশকান। “রবীন্দ্রনাথ মধ্য-বয়সের পর ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেছিলেন। তাই আমার মিনতি সত্ত্বেও উনি আর এলেন না। সেজন্যে মনের দুঃখে এমন নাম দিয়েছি। কথাটা তো সত্যি, তাই না?” নির্বাক ছফার দিকে তাকালো সে। “তুমি বিরক্ত হচ্ছো? এসব গল্প শুনতে ভালো লাগছে না?” আক্ষেপে মাথা দোলালো। “ও…সরি!”।
এবার উঠে দাঁড়ালো মুশকান। “তুমি আসলে শুনতে চাও ওদের আমি কি করেছি…তাই না?” তাকে একটু উদাস দেখালো। “তাহলে মন দিয়ে। শোনো, প্রথমজনকে আমি এখানে ডেকে আনি নি। ও নিজের আগ্রহেই চলে এসেছিলো। চমৎকার মানুষ ছিলো…রবীন্দ্রনাথে খাওয়ার পর আমার সাথে দেখা করলো, অনেক প্রশংসা করলো। সুযোগ পেলেই কাউকে কিছু না বলে চলে আসতো এখানে। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো। একদিন এই যে এখানে…” ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো সে। “…আমরা গল্প করছিলাম। পূর্ণিমা ছিলো সেটা। বাইরে জ্যোৎস্না। ওর মধ্যে কী যে হলো…” চোখ বন্ধ করে ফেললো মুশকান। “আমিও সাড়া দিলাম একজন আরেকজনকে পাবার জন্য পাগল হয়ে গেলাম, “ ছফার দিকে কেমন করে তাকালো। “কিন্তু ওর নগ্ন শরীর…ওর গন্ধ আমাকে এলোমেলো করে দিলো মুহূর্তে। ওর সাথে মিলিত হবার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।”
ছফার সামনে একটু পায়চারি করলো সে।
“ও প্রথমে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো আমাকে তারপর জোড়াজুড়ি…এক পর্যায়ে জবরদস্তি করতে লাগলো। ভীষণ ক্ষেপে গেলাম আমি। ওর ধারণাই ছিলো না আমি ওকে কি করতে পারি। ও আমাকে অন্যসব মেয়ের মতো ভেবেছিলো। দুর্বল। অসহায়।” বাঁকাহাসি দিলো সে। “দিলাম ওর ঘাড়টা মটকে!”
আধো-অচেতনের মধ্যেই আৎকে উঠলো ছফা। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে।
“ও মরে যাবার পর ভাবলাম ওকে এভাবে অপচয় করাটা ঠিক হবে না। তাই খেয়ে ফেললাম।”
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো নুরে ছফা।
“অনেক দিন পর আরেকজন আমার প্রতি ঝুকলো আবার. আমিও সুযোগ করে দিলাম। প্রশ্রয় দিলাম। কৌশলে এখানে এনে…” নিঃশব্দে হাসলো মুশকান জুবেরি। বাতাসে ঘ্রাণ নিলো সে। “তবে শেষের দু-জনকে পুরোপুরি কৌশল করে ডেকে এনেছি এখানে। ওরা চারুলতা’কে পাবার জন্য ঘরের বাইরে এসে হারিয়ে গেলো চিরতরের জন্য!” গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো। “আর তুমি…” ছফার খুব কাছে মুখ নিয়ে এলো সে। “তোমাকে আমি ডেকে আনি নি। তুমিও আমার টানে এখানে আসে নি। তাই ঠিক করেছি, তোমাকে আমি-”
একটা রিংটোন বেজে উঠলে চমকে তাকালো মুশকান। সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ছফা তার জ্যাকেটের খোলা জিপারের ভেতরে কোনোরকমে কম্পিত হাতটা ঢুকিয়ে দিতে পারলো। বুকপকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে আনতেই হাত থেকে সেটা পড়ে গেলো মেঝের ভারি কার্পেটের উপরে। ফ্যাল ফ্যাল চোখে সেদিকে চেয়ে রইলো সে।
মুশকান তাকালো ফোনের দিকে। ডিসপ্লেটা আলোকিত হয়ে আছে। কলার আইডি দেখতে পেয়ে নীচু হয়ে ফোনটা তুলে নিলো, তার ঠোঁটে দেখা গেলো মুচকি হাসি। কলটা রিসিভ করে স্পিকার অন করে দিলো, ফোনটা চেপে ধরলো ইনভেস্টিগেটরের ডানকানে।
“হ্যালো, নুরে ছফা?” ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন একটা কষ্ঠ শোনা গেলো। কিন্তু ডিবির তুখোড় ইনভেস্টিগেটর কোনো জবাব দিতে পারলো না।
“হ্যালো, আমার কথা শুনতাছেন? হ্যালো…”
“অ্যা…” একটা শব্দ বের হলো ছফার মুখ দিয়ে। তার জিভ ভারি হয়ে। গেছে, কথা বলতে গেলে গোঙানি বের হচ্ছে এখন। “সু-স্যা-স্যা!” বহু কষ্টে মাতালের মতো জড়ানো কণ্ঠে শুধু এটুকুই বলতে পারলো।
“ছফা, শুনেন…আপনে যেই মুশকানের কথা বলতাছেন সম্ভবত ঐ মহিলা সেই মুশকান না!”
নুরে ছফা চোখ কুচকে তাকালো তার সামনে থাকা মুখটার দিকে। সেই মুখে দুবোধ্য হাসি। কিছুটা তাচ্ছিল্যের, কিছুটা অবজ্ঞার!
ছফার কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নিলো ডাক্তার মুশকান। কলটা না কেটেই চেয়ারের পাশে কফি টেবিলের উপরে রেখে দিলো। ফোন থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা বেশ জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলো :
“ছফা! আপনে ঠিক আছেন তো? ছফা! নুরে ছফা!”
ঢুলু ঢুলু চোখে পাশ ফিরে ফোনের দিকে তাকালো ডিবির ইনভেস্টিগেটর, কিন্তু হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরার ক্ষমতা তার নেই।
.
ফোনের দিকে অবিশ্বাসে চেয়ে আছে কেএস খান। কলটা এখনও কেটে দেয়া হয় নি কিন্তু ছফার দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দও পাচ্ছে না।
জাওয়াদ তার দিকে ঝুঁকে ডিসপ্লেটা দেখলো। “স্যার, কি হলো?” তার কণ্ঠে আতঙ্ক।