জাওয়াদ মাথা নেড়ে সায় দিলো। “কিন্তু স্যার, একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না?”
“কি?”
“আপনি বলছেন আন্দিজের ঘটনাটা ১৯৭২ সালের… যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে মুশকান জুবেরির বয়স এখন কতো?”
কপালের ডানপাশটা চুলকে দ্রুত হিসেব কষে ফেললো কেএসকে। “উমমমম…পয়ষট্টি…না, না…ছেষট্টি!”
. “কিন্তু নুরে ছফা স্যার তো আমাকে বলেছেন মহিলা দেখতে যথেষ্ট স্মার্ট…অ্যাট্রাক্টিভ…মানে খুব সুন্দরি?”
“ষাইটের পর কি কেউ এরকম থাকবার পারে না?”
মাথা দোলালো জাওয়াদ। “স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন না.. ছফা স্যার বলেছেন, সুন্দরপুরের এমপি ঐ মহিলাকে বিয়ে করতে চাইছে। ছেষট্টি বছরের কোনো মহিলাকে একজন এমপি কেন বিয়ে করতে চাইবে?”
কেএস খান আবারো গাল চুলকালো। একটু ধন্দে পড়ে গেছে সে।
“এখন আমার মনে পড়েছে, ছফা স্যার ফোনে আমাকে ডিটেইল বলার সময় বলেছিলেন, ঐ মহিলার বয়স আনুমানিক ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের মধ্যে হবে।”
চমকে উঠলো মি, খান। “বলো কি!”
“জি, স্যার।” জোর দিয়ে বললো ছেলেটা।
“হায় হায়, সর্বনাশ হইয়া গেছে! মনে হইতাছে ছফা বিরাট বড় ভুল কইরা ফালাইছে!”
.
অধ্যায় ৩৮
বুকের কাছে দু-হাত ভাঁজ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মুশকান জুবেরি, তার দৃষ্টি সামনে বসা নুরে ছফার দিকে নিবদ্ধ। ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর যেনো আক্ষরিক অর্থেই হতবাক হয়ে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। কোলের উপরে পেপার-ক্লিপিংসের অ্যালবামটা নিয়ে বসে আছে সে। কখনও মনোযোগ দিয়ে ছবি আর নিউজগুলো পড়ছে, কখনও মুখ তুলে তাকাচ্ছে। যেনো ছবির একটি চরিত্রকে সামনাসামনি পেয়ে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছে বার বার।
“এ-এই ঘটনাটা তো…” ঢোক গিললো নুরে ছফা, “ মানে…” মাতালের মতো আচরণ করছে সে। চোখ দুটো দুলু ঢুলু। কথাটা শেষ করতে পারলো না।
“১৯৭২ সালে,” আস্তে করে বললো মুশকান জুবেরি। তার ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি। “তখন কি আপনার জন্ম হয়েছিলো?” তারপর মাথা দোলালো। সে। “আমার তা মনে হচ্ছে না।”
ছফা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো মহিলার দিকে।
“আপনার কথা বলার ক্ষমতা বোধহয় লোপ পেয়ে গেছে, স্থিরচোখে চেয়ে আবারো হাসি দিলো। “মনে হয় না যোগ-বিয়োগ করে বয়স বের করার মতো অবস্থাতে আপনি এখন আছেন।”
ছফা ঢোক গিললো। তার দৃষ্টি এখন ঝাপসা নয়, পানিতে প্রতিফলিত হওয়া প্রতিবিম্বের মতো টলমল করছে চারপাশের দৃশ্যপট।
“সমস্যা নেই। আপনার সমস্ত প্রশ্নের জবাব আমি নিজে থেকেই দিচ্ছি। ভালো করেই জানি আপনার মাথায় কোন কোন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।”
ছফা আবারো নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো। তার মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও অজ্ঞাত এক কারণে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
উঠে দাঁড়ালো মুশকান। ছফার সামনে এসে ভালো করে তাকালো তার চোখের দিকে, ডাক্তার যেভাবে রোগির চোখ পরীক্ষা করে ঠিক সেভাবে। মনে হলো সসতুষ্ট হয়েছে।
ছফা টের পেলো মহিলার গায়ের গন্ধ! সেই গন্ধ মোহনীয়; মাদকতাপূর্ণ, দুর্দমনীয়! জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো সে।
“আহ” মায়াবি কণ্ঠে বলে উঠলো মুশকান। “মাথাটাকে এবার একটু বিশ্রাম দিন। কী দরকার যোগ-বিয়োগের হিসেব করে। বললামই তো..আমি আপনার সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবো। আপনাকে কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না-ভাবতেও হবে না।”
নুরে ছফার মনে হলো সে বাস্তবের কোনো জগতে নেই। অপার্থিব এক জগতে, অমর্ত্যের এক অপ্সরার মুখোমুখি বসে আছে।
“তখন আমার বয়স ছিলো পঁচিশ!” লাস্যময়ীহাসি দিয়ে বললো মুশকান। “কি, বিশ্বাস হচ্ছে না?” ছফার থুতনিটা আলতো করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো। “স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে?”
শুধুমাত্র মুখটা একটু হা করতে পারলো ছফা। আস্তে করে তার সেই ঠোঁটে তর্জনি দিয়ে স্পর্শ করলো মুশকান। আরো গভীরভাবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। যেনো বোঝার চেষ্টা করছে ডিবির ইনভেস্টিগেটরের মাথায় কোন চিন্তাটা খেলা করছে এ মুহূর্তে।
“আমি কে?” নিঃশব্দে হাসলো। “আমি কে!”
ছফা নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো কেবল।
“তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে চাও, তাই না?” ছফার ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ালো সে। “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসে নি…এই নামটা নিয়ে তোমার কোনো প্রশ্ন নেই? কেন আমি এমন নাম দিলাম?”
ছফার ঠোঁট দুটো সামান্য কেঁপে উঠলো।
“অন্যেরা তোমাকে এ সম্পর্কে কিছু বলেছে?” মাথা দোলালো আপন মনে। “ওসব একদম সত্যি না।”
মৃদু গোঙানি দিতে পারলো নুরে ছফা।
“আহ, তুমি কিছু বোলো না…যা বলার আমিই বলছি।” তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলো সে, “আমি আসলেই রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। সেই ছোটোবেলা থেকে। আমার মা খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো..আমাকেও শিখিয়েছিলো। ছায়ানটের প্রথমদিকার ছাত্র ছিলাম আমি। ৬২-তে যখন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হলো, সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম…তখন অবশ্য আমি অল্পবয়সি কিশোরী।” ছফার দিকে তাকালো সে। “ঠিক এভাবে লক্ষমীছেলের মতো বসে থাকো।” কানের পাশ থেকে আবারো চুল সরিয়ে নিলো। “এরপরই বাবার চাকরির কারণে আমরা সপরিবারে আমেরিকায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা মা-মেয়ে রবীন্দ্রচর্চা অব্যাহত রেখেছিলাম। সকালের শুরু আর রাতে ঘুমাতে যাবার আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা-গাওয়া আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো।” একটু থেমে আবার বললো, “তো, কয়েক বছর আগে যখন সুন্দরপুরে রেসটুরেন্ট দেবো তখন সেটার নাম নিয়ে খুব একটা ভাবি নি। রবীন্দ্রনাথের অজস্র কবিতা, গান আমার মুখস্ত. তার গল্প-উপন্যাসের অনেক চরিত্রই আমার প্রিয়…ওখান থেকে একটা বেছে নিতে কী আর এমন কঠিন কাজ।” ছফার দিকে তাকালো স্থিরচোখে। “সত্যি বলতে, চারুলতা আর ঘরে-বাইরে নাম দুটোই আমার প্রথম পছন্দ ছিলো। কিন্তু নাম দেবার আগে একটা পাগলামি করে বসলাম।”