বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর।
“কি মেশায়?”
“সেইটা কেমনে কই তয় কিছু একটা তো করেই.” একটু থেমে গলাটা নীচু করে বললো, “কবুতর তো বশ করে আফিম দিয়া, হে কি দিয়া বশ করে কে জানে?”
একবার বলে ডাইনি আবার বলে আফিম মেশানোর কথা-ছফা বুঝতে পারলো এই লোক মুশকান জুবেরির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। কবুতর আফিম দিয়ে বশ করা হয় মানে?” কৌতূহলি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে জানতে চাইলো সে। “কবুতর তো এমনিতেই পোষ মানানো যায়..বশ করার জন্য আফিম মেশানোর দরকার হবে কেন? এরকম কথা জীবনেও শুনি নি।”
লালচে দাঁত বিকশিত হলো আতরের। “আপনে তাইলে জানেন না। কবুতর যারা পালে তারা কবুতরের খাওনের মইদ্যে ইটটুখানি আফিম মিশাইয়া দেয়, ঐ আফিম খাইয়া খাইয়া কবুতরের নিশা হইয়া যায়। কঠিন নিশা।”
“নিরীহ কবুতরকে আফিমের নেশা করিয়ে কী লাভ? আফিম তো সস্তা নয়, বেশ দামি।”
– “লাভ না হইলে কেউ ট্যাকা খরচ কইরা আফিম খাওয়াইবো?” একটু থেমে আবার বললো, “কেন আফিম মিশায় জানেন?” ছফার জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে লাগলো সে, “আফিমখোর কবুতরগুলা হাটে নিয়া বেইচা দেয়, তারপর যারা ঐসব কবুতর কিনা নেয় তারা খায় ধরা, বুঝলেন?”
“কিভাবে ধরা খায়?”
“ঐ কবুতরগুলা উড়াল দিয়া পুরান মালিকের কাছে চইলা আহে আফিমের টানে। তারপর ওইগুলারে আবার বেইচা দেয়, আবার উড়াল দিয়া ফিরা আহে আহে আর বেচে..লাভই লাভ…এক কবুতর দশবার বেচতে পারে হেরা।”
“ও,” দারুণ বিস্মিত নুরে ছফা। “আপনার ধারণা ঐ রেস্টুরেন্টও একই কাজ করে?”
“কিছু একটা তো দেয়ই না দিলে মানুষ নিশাখোরগো মতোন ছুঁইটা আইতো না।”
“আপনি এতোটা নিশ্চিত হলেন কিভাবে? ঐ রেস্টুরেন্টের রান্না বান্নার খবর তো আপনার জানার কথা নয়?”
বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো আতরের ঠোঁটে। “তাইলে হূনেন, বেটির হোটেলে বাবুর্চির কাম করতে এক পোলা…হে আমারে কইছে, বেটি নাকি সব খাওনের মইদ্যে কী একটা মিশাইয়া দেয়।”
“কি মেশায়?” নড়েচড়ে উঠলো ছফা।
“এইটা তো ঐ পোলায়ও বাইর করতে পারে নাই” আশেপাশে তাকিয়ে এবার নীচকণ্ঠে বললো সে, “বুঝলেন, সব খাওন পাক করার সময় কী জানি একটা জিনিস মিশাইয়া দেয়। বেটি ওইগুলা বোতলে কইরা নিজের বাড়িতে রাখে। রান্দোনের আগে বোতলগুলা নিয়া আসে কর্মচারীরা। ওই বোতলে কি আছে কেউ কইবার পারে না। বাবুর্চি আমারে কইছে, বোতলের সিরাপগুলার জইন্যই খাওনগুলা এতো মজার হয়। এইটা দিয়া-ই সবতেরে জাদু কইরা ফালায়। বার বার ছুঁইটা আসে কাস্টমার।”
“কিন্তু আমি তো আজ খেয়েছি, আমার কাছে ভালো লাগে নি…দ্বিতীয়বার ওখানে গিয়ে খেতেও ইচ্ছে করছে না।”
একটু সন্দেহের চোখে তাকালো আতর। “ক কি?”
“হুম। একদম সত্যি বলছি।”
“তাইলে আপনের কে আলাদা,” বলেই মুখ টিপে হাসলো।
“আলাদা হবে কেন?”
“কিছু মনে কইরেন না…আপনে মনে হয় নিশা-পানি করেন,” কথাটা বলেই আবারো দাঁত বের করে হেসে উঠলো পুলিশের ইনফর্মার।
নুরে ছফা একটু থ বনে গেলেও বেশ শব্দ করে হাসলো। “হা-হা-হা।”
আতর আলী ভ্যাবাচ্যাকা খেলো একটু।
“আপনি লোকটা আসলেই খুব মজার। আপনার জ্ঞান-বুদ্ধির প্রশংসা। না করে পারছি না। আপনার অবজার্ভেশন ক্ষমতা মারাত্মক।”
এবার নিঃশব্দে হাসতে লাগলো ইনফর্মার।
“একদম ঠিক ধরেছেন, আমার একটু বদঅভ্যাস আছে।”
“নিশা-পানি করলে জিব নষ্ট হইয়া যায়..তহন আর অন্য কিছু ভালা লাগে না,” কথাটা বলে একটু থেমে আবার বললো, “আপনে কি খান?”
“তেমন কিছু না…এই ধরেন একটু গাঁজা-মদ।”
“আমি ইমুন সাম্বাদিক দেখি নাই যে এইসব জিনিস খায় না, একদম নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো আতর। “সব সাম্বাদিকই গাঞ্জা-মদ খায়, বুঝলেন? এইগুলা না খাইলে হেরা কামই করতে পারে না।”
“সবাই খায় কিনা জানি না, আমি খাই। তবে এখানে আসার পর বিপদে পড়েছি…গাঁজা-মদ কিছু পাচ্ছি না।”
“আরে কী কন, এইলা কুনো ব্যাপার হইলো..এই আতররে খালি কইবেন, কয় মণ গাঞ্জা চান? কয় ডেরাম মদ লাগবো? চুটকি বাজামু আর সব হাজির হইয়া যাইবো।”
“আপনি এসবের কারবারও করেন নাকি?”
আতর লাজুক হাসি দিলো। “আমি করি না, তয় যারা করে তারা সবুতে আমারে বাও কইরা কাম করে..আমারে হাতে রাখে আর কি. আমার লগে এগোর হট টেরাম আছে।”
“তাহলে আপনি থাকতে এসব নিয়ে আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না মনে হচ্ছে।”
“খালি কইবেন, বান্দা জিনিস লইয়া হাজির হইবো।” একটু থেমে আবার বললো সে, “উঠছেন কুনখানে?”
“টাউনের হোটেলে।”
ভুরু কুচকালো আতর। “ঐযে সুরুত আলীর তিনতলার হোটেলে? সানমুনে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। এই টাউনে আবাসিক হোটেল ঐ একটাই।
“আর জায়গা পাইলেন না..সুরুত আলী তো ঐটারে খানকিপট্টি বানায়া রাখছে। সব ভুসকি মাগিগো আড্ডাখানা। আপনের মতো মানুষ কেমনে উঠলো ঐখানে?”
“আমি তো এখানকার তেমন কিছু চিনি না। এখানে আমার পরিচিত কেউ নেইও…ঐ হোটেলে না উঠে উপায় ছিলো না।”
“আচ্ছা, ওরা আপনার কাছ থিকা পার ডে কতো নিতাছে?”
“তিনশ”
আতরের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “পুরা ডাকাইতি। ওইটা কি ফাইভস্টার নি…ওইখানকার রুমের ভাড়া তো দুইশ’ টাকা।”
“তাই নাকি?” নুরে ছফা কৃত্রিম বিস্ময়ের ভঙ্গি করলো।
“ওরা আপনের গলা কাটতাছে। খাড়ান, আমি রাইতে গিয়া ফাপড় দিতাছি, দেখবেন ভাড়া কেমনে নাইমা আসে।”