নুরে ছফা মুখ খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো মুশকান।
“আপনাকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলছি।” একটু থেমে গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো আবার। “আমরা সবাই উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে লাগলাম…যে কেউ যে কাউকে খুন করে খেয়ে ফেলতে পারে। বরফে ঢাকা উপত্যকায়…মাটি থেকে সাত হাজার মিটার উপরে পশুর মতো বেঁচে রইলাম আমরা কয়েকজন মানুষ।”
ছফা আরেকটি পৃষ্ঠা উল্টালো। কিছু পেপার-ক্লিপিংসের সাথে ছবিও আছে মনেক। কিন্তু স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে তার।
“অবশেষে একদিন সকালে হুট করেই একটা হেলিকপ্টার দেখতে পলাম আকাশে।”
ছফা চোখ দুটো পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলো। একদল উদ্ধার পাওয়া মানুষের ছবি ভেসে উঠলো তার সামনে।
.
অধ্যায় ৩৭
কেএসকে চুপ মেরে আছে। ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদও কিছু বলছেন না। জাওয়াদ নিজের সিটে এপাশ-ওপাশ করছে বলে খ্যাচখ্যাচ করে শব্দ হচ্ছে, সেই শব্দটাই সুকঠিন নীরবতাকে জমাট বাঁধতে দিচ্ছে না।
“বুঝতেই পারছেন,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডাক্তার। “মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচে যাওয়াদের ব্যাপারে সমাজ আর আশেপাশের মানুষ কেমন আচরণ করে।”
কেএসকে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে একমাত্র মুশকানই ছিলো এশিয়ান…মুসলিম…” চশমাটা খুলে পরিস্কার করে নিলেন ডাক্তার। “ তার অবস্থা হয়েছিলো খুবই শোচনীয়। নিজের পরিবার থেকেও সে বিরূপ মনোভাবের শিকার হয়। খুব দ্রুতই তার জীবনটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।”
চুপ মেরে রইলো কেএসকে৷ সে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। যেখানে আমাদের দেশে একজন ধর্ষিতাকেই সব অপমান আর গঞ্জনা সইতে হয় সেখানে মানুষের মাংস খাওয়া একজনের সাথে কি আচরণ করা হবে সেটা অনুমেয়। আমেরিকায় থাকলেও নিজের কমিউনিটিতে কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছে মুশকানকে। একদম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়াটা আর সম্ভবও হয় নি।
“এই কথাটা আমাদের হাসপাতালে জানাজানি হয়ে গেলে ভীষণ সমস্যা হবে…রেপুটেশনের ব্যাপার…বুঝতেই পারছেন।”
ডাক্তারের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো কেএস খান।
“তাই আমি মুশকানকে একটা অফার দিলাম,” ডাক্তার একটু কেশে নিলেন। “হাসপাতালের চাকরিটা সে ছেড়ে দিয়ে একজন কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে…পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করতে কোনো সমস্যা নেই…কিন্তু মুশকান এই প্রস্তাবে রাজি হয় নি। সে চাকরি ছেড়ে দেয়।”
“তখন কি উনি মি. জুবেরিকে বিয়ে করেছেন?” এই প্রথম জাওয়াদ কোনো প্রশ্ন করলো।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডাক্তার। “এই ঘটনার মাসখানেক আগেই। ওদের বিয়েটা হয়।”
কথাটা শোনার পর অনেকক্ষণ চুপ মেরে রইলো কেএসকে। এরকম অভাবনীয় ঘটনা শুনতে হবে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি। আন্দিজের এই প্লেন ক্রাশের উপরে দু-দুটো বই আছে, একটা সিনেমাও বানানো হয়েছে। সিনেমাটা না দেখলেও বই পড়েছে অনেক আগে। খুবই লোমহর্ষক কাহিনী। বইটা পড়ার পর প্রায় মাসখানেক সে কোনো ধরণের মাংস খেতে পারে নি। মাংস দেখলেই তার মনে হতো নরমাংসের কথা। একদল বিপন্ন মানুষ লাশ কেটে খাচ্ছে!
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় খোদাদাদ শাহবাজ খান নড়েচড়ে বসলো। “ডাক্তার, ঐ ঘটনার উপরে আমি দুইটা বই পড়ছি…ওইখানে তো মুশকান নামের কোনো ক্যারেক্টারের কথা লেখা নাই?!”
কথাটা শুনে ছফার সহকারী জাওয়াদ গোল গোল চোখে চেয়ে রইলো, তবে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “মুশকানের অনুরোধে বই দুটোর লেখক তার নাম ব্যবহার করে নি। তার চরিত্রটি অন্য নামে আছে বইয়ে।”
কেএস খান চুপ মেরে গেলো।
“মুশকান জানতো, এটা জানাজানি হলে সামাজিকভাবে কি রকম সমস্যায় পড়তে পারে।” দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো ডাক্তারের ভেতর থেকে। “বই লেখার অনেক আগেই সে তার নিজের কমিউনিটি আর পরিবারের কাছ থেকে বিরূপ আচরণের শিকার হয়েছিলো। ওদের কাছে এটা লুকানো যায় নি।”
“এই কারণেই মুশকান আমেরিকায় থাকে নি,” অস্কুটস্বরে বললো কেএস খান।
“ও বুঝতে পেরেছিলো বইতে ওর কথা লেখা হলে শুধু আমেরিকায় নয়, পৃথিবীর সবখানেই বিরূপ আচরণের শিকার হবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ডিবির সাবেক কর্মকর্তা। ঘটনাটা আসলেই প্যাথেটিক। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বললো না।
“অনেক রাত হয়েছে, আমি আবার আলি রাইজার।”
সম্বিত ফিরে পেয়ে ডাক্তারের দিকে মুখ তুলে তাকালো কেএসকে।
হাতঘড়িতে হাত রেখে বললেন তিনি, “একটু স্টাডি করে ঘুমাতে যাবো। আপনাদের যদি আর কিছু জানার না থাকে তাহলে…”
মাথা নেড়ে সায় দিলো কেএস খান। জাওয়াদকে ইশারা করে নিজেও উঠে দাঁড়ালো। “সরি, ডাক্তার। আমরা আর আপনের সময় নষ্ট করুম না।” কথাটা বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো সে।
ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ উঠে দাঁড়িয়ে কেএসকের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে সৌজন্যমূলক মাপায়সি দিলেন।
“থ্যাঙ্কস ফর গিভিং আস ইওর ভ্যালুয়েবল টাইম।”
ডাক্তার আর কিছু না বললে জাওয়াদকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো সে। অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে লিফটের সামনে এসে হাই তুললো। “কি জানতে আসলাম আর কি জানলাম,” অনেকটা বিড়বিড় করে বললো সাবেক ডিবি কর্মকর্তা। “আমি কখনও ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই সেভেনটি টু-র এই আলোড়নসৃষ্টিকারী ঘটনায় আমাদের দেশের কেউ ছিলো।” হাফ ছাড়লো মি. খান। “শেক্সপিয়ার কইলাম অনেক আগেই বইলা গেছে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান। একদম সত্যি কথা।”