“প্লেনে থাকা কিছু খাবার আর পানি অল্প অল্প খেয়ে পাঁচ-ছয় দিন পার করলাম আমরা…এরমধ্যে আহত আরো তিনজন মারা গেলো। ওরকম জায়গায় শুধুমাত্র ফাস্টএইড দিয়ে ওদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি।”
ছফা মুখ তুলে তাকালো। মুশকাল জুবেরকে ঝাপসা দেখলো সে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারলো না।
“একসপ্তাহ পর আমরা যারা বেঁচে ছিলাম তারা টের পেলাম খিদে কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। না-খেয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে।”
ছফা আরেকটি ক্লিপিংসের দিকে চোখ বুলালো। একই খবর। একই ছবি। তবে ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকার।
“খিদের কাছে সব পরাজিত হয়। সবার আগে পরাজিত হয় স্বাদ-রুচি। তারপর যুক্তি-বুদ্ধি, সভ্যতা, মানবিকতা।”
মুখ তুলে তাকালো নুরে ছফা।
‘আমাদের মধ্যে নরম্যান নামের এক যুবক ছিলো। প্রথমে ও-ই প্রস্তাব করলো মূতষাত্রিদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি আমরা। প্রচণ্ড শীত আর বরফের মধ্যে থাকার কারণে লাশগুলো পচে যায় নি।”
ছফা টের পেলো তার পেটটা গুলিয়ে উঠছে। মৃত মানুষের মাংস! দৃশ্যটা ভাবতেও কষ্ট হলো।
“প্রথমে কেউ রাজি হয় নি..কিনতু আরো তিনদিন অভুক্ত থাকার পর…” কথা বলা থামিয়ে দিলো মুশকান। “…আগেই বলেছি, খিদের কাছে। সবকিছু হেরে যায়।”
ক্রমশ তার সামনে বসে থাকা মুশকান জুবেরি আরো বেশি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। যেনো এক মায়াবি তার মায়ার জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। চারপাশে এক ধরণের কুয়াশা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আগের চেয়েও বেশি।
“যাত্রিদের মধ্যে একজন ডাক্তার ছিলো কিন্তু সে ছিলো মারাত্মক আহত…তাই ওরা সবাই সদ্য মেডিকেল থেকে বের হওয়া আমাকেই বললো মৃত মানুষগুলোর কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়ার উপযোগী আর পুষ্টি জোগাবে বেশি…” একটু থামলো মুশকান। “…দিনের পর দিন আমরা মুতদের খেয়ে বেঁচে রইলাম…অপেক্ষা করতে লাগলাম উদ্ধার পাবার জন্য। যদিও ততদিনে অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। বাঁচার আশা কেউ করছিলো না।”
আরেকটা ক্লিপিংস আর ছবির দিকে তাকালো ছফা ভগ্নপ্রায় প্লেনের বাইরে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেঁচে থাকা কিছু মানব-সন্তান। তাদের প্রত্যেকের চেহারা বিধ্বস্ত, শরীর দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মতোই।
“এভাবে এক মাস চলে গেলো কিন্তু কেউ এলো না আমাদের উদ্ধার করতে।”
ছফা আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টালো কম্পিত হাতে।
“লাশগুলো কেটে খাওয়ার উপযোগী অংশগুলো আমরা বরফের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতাম সংরক্ষণ করার জন্য। প্লেনের ভেতরে পাওয়া ম্যাচবক্স থেকে আগুন জ্বালিয়ে এটা ওটা পুড়িয়ে বরফ গলিয়ে খাবার পানি তৈরি করে নিতাম। কিন্তু কোনো কিছুই যথেষ্ট ছিলো না। ক্রমশ বনের পশুর মতো হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। অভুক্ত পশু! হিংস্র আর অসভ্য। শুধু বেঁচে থাকাটাই যেনো একমাত্র লক্ষ্য। আর কোনো উদ্দেশ্য নেই আমাদের সামনে।”
পেপার ক্লিপিংস থেকে চোখ সরিয়ে মুশকানের দিকে তাকিয়ে রইলো। নুরে ছফা। তার মুখে কোনো রা নেই। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। চোখের সামনে মুশকানের অবয়বটি কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে, তরঙ্গায়িত হচ্ছে! তার কথাগুলো যেনো বহূদূর থেকে ভেসে আসা গুঞ্জনের মতো শোনাচ্ছে এখন।
“আহত, রোগগ্রস্ত মানুষগুলো টিকে থাকার অনেক চেষ্টা করেও একে একে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। তারা হয়ে উঠলো আমাদের আহার!”
ছফার বমি বমি ভাব হলো। “এভাবে দু-মাস চলে গেলো কিন্তু উদ্ধারের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। এবার প্রায় সবাই আশা ছেড়ে দিলো। তিনজন সাহসী যুবক চেষ্টা করলো পাহাড় থেকে নীচে নামার। আমরা বাঁধা দিলাম, কিন্তু তারা ছিলো বেপরোয়া, কারো কথা শুনলো না। একটু থামলো মুশকান জুবেরি। “ওদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি..সম্ভবত ভুলপথে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে.কিংবা দুর্ঘটনায় পড়ে থাকবে হয়তো।”
এসব কথা আর শুনতে চাইছে না ছফা কিন্তু মুখ ফুটে বলতেও পারছে না।
“শেষদিকে প্রায় দু-দুটো সপ্তাহ আমরা কেউ ঘুমাতে পারি নি।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর। তার সেই দৃষ্টি ঢুলু ঢুলু।
“খাবার উপযোগী লাশ ফুরিয়ে গেছিলো..যারা বেঁচে ছিলাম তারা মনে মনে আশা করতাম কেউ হয়তো এমন কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে মরে যাবে আর আমরা…”
ছফার বমি বমি ভাবটা আবারো ফিরে এলো।
“কিন্তু কেউ আর মরছিলো না, দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান। “দু মাসেরও বেশি সময় ধরে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করে আমরা হয়তো টিকে থাকার অসামান্য ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিলাম। কোনো কিছুই আর আমাদের পরাজিত করতে পারছিলো না।”
ছফা আরেকটি পৃষ্ঠা উল্টালো।
“আরো পাঁচদিন কোনো কিছু না খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। খিদে আমাদেরকে অসভ্যতার চরম অবস্থায় নিয়ে গেলো। একরাতে আমাদের মধ্যে একজন অন্য একজনকে হত্যা করে ফেললো!”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ছফা।
“আমরা সবাই বুঝতে পারলাম কিন্তু এ নিয়ে কেউ কিছু বললাম না। আরো কয়েকটা দিনের আহার তো হলো!” একটু থেমে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো মুশকান। “ঐ ঘটনার পর থেকে আমরা কেউ রাতে ঘুমাতাম না…কেউ কাউকে বিশ্বাস করতাম না। সবাই সতর্ক থাকতাম। সবাই জানতাম এরপর কি হতে চলেছে…” এবার ছফার দিকে তাকালো। “একদল আরেক দলকে মেরে ফেলবে…নিজেদের আহার বানাবে!”