সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ভদ্রলোক।
“এই বিরাট ঝামেলা থেইকা নিজেরে পুরাপুরি দূরে রাখতে চাইলে খুব সহজেই সেইটা আপনে করতে পারেন। সত্যিটা বইলা দেন। আলটিমেটলি এইটা আপনে লুকায়া রাখতে পারবেন না…ঘটনাটা অনেকেই জানে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডাক্তার। জাওয়াদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সেও বুঝতে পারছে ডাক্তার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। মনে মনে কেএস খানের প্রশংসা না করে পারলো না।
“কোন সত্যটা জানতে চান?”
“মুশকান জুবেরি চাকরিটা ছাড়লো কেন?”
একটু চুপ থেকে বললেন ডাক্তার, “ও কেন চাকরিটা ছেড়েছে সেটা এক কথায় বলা যাবে না। একটু ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা।”
“করেন…কোনো সমস্যা নাই,” অভয় দিলো মি. খান।
“আপনারা হয়তো জানেন না মুশকান সপরিবারে আমেরিকায় থাকতো…ওখান থেকেই পড়াশোনা কমপ্লিট করেছে।”
আগ্রহভরে চেয়ে রইলো কেএস খান।
“পাঁচ-ছয় বছর আগে আমেরিকা থেকে আমাদের হাসপাতালে এক ডাক্তার এসে জয়েন করে। ঐ ডাক্তার মুশকানকে চিনতো। ওরা পড়াশোনা করেছে একই মেডিকেল কলেজে…মুশকানের কয়েক বছরের জুনিয়র সে…” ডাক্তার একটু থেমে কথা গুছিয়ে নিলেন। “ও জয়েন করার পর মুশকানের ব্যাপারে খুবই অদ্ভুত আর গা শিউরে ওঠার মতো একটি কথা ভেসে বেড়াতে লাগলো। হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট অবশেষে এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললো। আমি মুশকানকে আমেরিকায় থাকতেই চিনি। ওর সব কিছু জানি।”
অবাক হলো কেএস খান। “বলেন কি?”
ডাক্তার চুপ মেরে রইলেন।
“কিন্তু কথাটা কি ছিলো?” মি. খান উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
“ফাইনাল ইয়ারে মুশকান তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সাউথ আমেরিকা টুরে গিয়ে মারাত্মক এক প্লেন ক্রাশের শিকার হয়েছিলো। ওদের প্লেনটা ক্র্যাশ করে আন্দিজের দূর্গম এক পাহাড়ি অঞ্চলে।”
“আন্দিজে?”
“হুম। ঘটনাটা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে, ইনফ্যাক্ট ঘটনাটা নিয়ে অনেক প্রবন্ধ, বই, এমনকি সিনেমাও তৈরি হয়েছে।” একটু থেমে আবার বললেন ভদ্রলোক, “কিন্তু ও যেভাবে বেঁচেছে সেটা শুনলে যে কারোর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে।”
“কি সেইটা?”
একটু থেমে গুছিয়ে নিলেন ডাক্তার। “শুধু ও নয়…ওই প্লেনের একশ’রও বেশি যাত্রির মধ্যে মাত্র আঠারোজন বেঁচে গিয়েছিলো। অবশেষে কয়েক মাস পর তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। পুরো ব্যাপারটাকে আন্দিজের মিরাকল বলেই জানে সবাই। বিস্ময়কর একটি ঘটনা। ওরকম জায়গায় ওদের বেঁচে থাকার কথা নয়।”
“তাইলে ওরা অ্যাতোদিন বাঁচলো কেমনে?”
কেএস খানের প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে গেলেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “মানুষ খেয়ে!”
» ৮. মানুষের মাংস
অধ্যায় ৩৬
ওরা মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচেছিলো!
অ্যালবামটা কোলের উপর রেখে হতভম্ব হয়ে বসে আছে নুরে ছফা। এটা জানার পর তার মাথা রীতিমতো ভো ভো করছে। সভ্য দুনিয়ার কিছু মানুষ দূর্গম অঞ্চলে আটকা পড়ে মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচে ছিলো আশিদিনেরও বেশি সময় ধরে।
সে টের পাচ্ছে একটা অবশ করা যোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে যেনো। তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে এটা। কল্পনা করতেই সারা শরীর গুলিয়ে উঠলো।
“কেউ জানতো না আমরা অনেকেই বেঁচে ছিলাম, তাই উদ্ধার করতেও আসে নি,” বললো মুশকান। “সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম রেসকিউ টিম এসে আমাদের উদ্ধার করবে, কিন্তু পাঁচদিন পরও কেউ এলো না।”
ছফা অ্যালবামের দিকে তাকালো। পেপার-ক্লিপিংসে ছড়াছড়ি। সবগুলোই আসল পত্রিকা থেকে কেটে লাগানো হয়েছে, কোনো ফটোকপি নয়। একটা ক্লিপিংসের দিকে চোখ গেলো তার। বড় বড় বোল্ড অক্ষরে লেখা গা শিউরে মুঠা হেডলাইন আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্লেনের ছবি।
ছফা চোখ সরিয়ে নিলো। আরেকটা ক্লিপিংসের দিকে তাকালো সে। ওটা বলছে, মোট ১০২ জন যাত্রির মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পয়ষট্টিজনের তো, বাকি সাইত্রিশ জনের বেশিরভাগই মারাত্মক আহত ছিলো, একদম সুস্থ, কিংবা সামান্য আহত ছিলো মাত্র বারোজন।
“সাত হাজার মিটার উঁচু পাহাড়ের কোলে আমাদের বিমানটি আছড়ে পড়ে খুবই দুর্গম এলাকায়। বরফে ঢাকা উপত্যকা…প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর ঝড়ো বাতাস…কোনো পানি নেই..খাবার নেই…গাছপালাও নেই যে পাতা খেয়ে বেঁচে থাকা যাবে…কোনো জীব-জন্তুরও দেখা পাই নি ওগুলো শিকার করে ক্ষুধা মেটাতে পারবো।”
ছফা আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে টের পেলো তার হাত একটু কাঁপছে। ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা শুনে হয়তো তার নার্ভ সিস্টেমও ভড়কে গেছে! কম্পিত হাতেই পৃষ্ঠাটা ওল্টালো। আরো কিছু ক্লিপিংস। আন্দিজের ম্যাপ, বিমানটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছে সেই জায়গাটি বৃত্ত এঁকে চিহ্নিত করা। ভাঙাচোরা বিমানের ভেতরে বসে থাকা জীবিতদের ছবি।
“এই ছবিগুলো আমার ক্যামেরায় তোলা হয়েছিলো,” জানালো মুশকান। তার মধ্যে এক ধরণের উদাস ভাব চলে এসেছে। “যদি আমাদের মধ্যে একজনও জীবিত অবস্থায় সভ্য-দুনিয়ার ফিরে যেতে পারে তাহলে ছবিগুলো সবাই দেখতে পাবে…কিংবা আমাদের সবার মৃত্যুর পরও যদি কেউ ওখানে আসে তাহলে ছবিগুলো আলোর মুখ দেখবে-এই উদ্দেশ্যেই তুলেছিলাম।”
ছফা দেখলো একটা ছবিতে বাকিদের সাথে তরুণী মুশকানও বসে আছে বিধ্বস্ত প্লেনের ভেতরে। ভারি সোয়েটারে তার শরীর আর মাথা ঢাকা থাকলেও মুখটা দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না।