ছষ্ঠ পৃষ্ঠায় যেতে আবরো বেগ পেলো, পরের পাতার সাথে লেগে আছে। ষষ্ঠ আর সপ্তম পৃষ্ঠায় মেডিকেল কলেজের প্রচুর ছবিতে ভরতি। কোনোটাতে মুশকানের গায়ে অ্যাপ্রোন, কোনোটাতে সাধারণ টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। ছফা মনে মনে মুশকান জুবেরির সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে পারলো না।
যৌবনে এই মহিলা চোখ ধাঁধানো সুন্দরি ছিলো।
না, এখনও আছে।
নিজেকে শুধরে দিলো সে। চোখ তুলে তাকালো মহিলার দিকে। বয়স বাড়লেও খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। শরীরের গড়ন প্রায় আগের মতোই আছে।
“মেডিকেল কলেজের মতো ভালো সময় আমার জীবনে খুব কমই এসেছে। পড়াশোনার চাপ থাকলেও আমি খুব এনজয় করেছি সময়টা।”
অষ্টম পৃষ্ঠাটিও পরের পৃষ্ঠার সাথে লেগে আছে। ছফা বিরক্ত হয়ে পাতাটি ওল্টালো। পাতাগুলো একটার সাথে একটা শুধু লেগেই নেই, কেমন। পুরনো গন্ধ আর চটচটে হয়ে আছে। ছফা দেখতে পেলো কতোগুলো ছবি। প্রায় সবগুলোতেই একদল তরুণ-তরুণী এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেছনে সারি সারি দাঁড় করানো প্লেন। ক্যামেরার দিকে থাম্ব-আপ দেখাচ্ছে। সবাই। একজন ছেলের হাতে প্ল্যাকার্ড বন ভয়েজ! একটা ছবিতে তরুণী মুশকান ভেংচি কাটছে ক্যামেরাম্যানকে। তার পেছনে বন্ধুবান্ধবের দল। সেখানে চিনা-জাপানি, লাতিন-কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের সন্নিবেশ। মুচকি হাসলো সে। তারুণ্য এমনই। সব কিছুতে ফুর্তি। মজা।
“টুরে যাবার আগের ছবি…” আস্তে করে বললো মুশকান।
পরের পাতা উল্টিয়ে ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। এখানে কোনো ছবি নেই। আস্ত একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রায় অর্ধেকটা পেপারক্লিপিংস রাখা হয়েছে। ডানদিকের পৃষ্ঠায় আরেকটি পত্রিকা আরেকটি পেপার-ক্লিপিংস। আমেরিকার বিখ্যাত দুটো পত্রিকা-ওয়াশিংটন পোস্ট আর বাল্টিমোর ট্রিবিউন। দুটো পত্রিকাই একটি নিউজ ব্যানার হেডলাইন করেছে: মর্মান্তিক এক প্লেন ক্র্যাশ।
ছফা মুখ তুলে তাকালো মুশকানের দিকে।
“মাচুপিচু দেখে ফেরার পথে আমাদের প্লেনটা খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে ক্র্যাশ করে…” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “…আন্দিজের অনেক উপরে…বরফে ঢাকা একটি উপত্যকায়…”।
পত্রিকার রিপোর্টের দিকে নজর দিলো ছফা। ওখানে বিস্তারিত বলা আছে। প্লেনটা আন্দিজ পর্বতমালার উপর দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করে হারিয়ে গেছে। সবাই ধারণা করছে প্লেনটা বরফে ঢাকা পার্বত্য-অঞ্চলের কোথাও বিধ্বস্ত হয়েছে। যাত্রিদের কারোর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। অন্য একটি ছোট্ট পেপার-ক্লিপিংসে আছে, তিনদিন ধরে রেসকিউ টিম চেষ্টা করেও প্লেনের কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় নি। কর্তৃপক্ষ আশংকা করছে। প্লেনের কোনো যাত্রি বেঁচে নেই!
ছফা আবারো মুখ তুলে তাকালো মুশকানের দিকে। মহিলাকে কেমনজানি অশরীরি বলে মনে হচ্ছে এখন। তারপর একটা ভাবনা মাথায় আসতেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। সবাই যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে সামনে যে বসে আছে সে কে?!
.
অধ্যায় ৩৫
কেএস খান বুঝতে পারছে তাকে কেন এই কাজটা করতে বলেছে নুরে ছফা। যদিও এটা ডিবির লোকজনের করার কথা কিন্তু ও চাইছে দ্রুত ফলাফল বের করে আনতে। আর যে লোককে ইন্টেরোগেট করা হবে তিনি অনেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি-দেশের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। বয়সে প্রবীণ এই ভদ্রলোকের সাথে ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ের অনেকেরই সু-সম্পর্ক রয়েছে। তাকে সাধারণ লোকজনের মতো হূমকি-ধামকি দিয়ে জেরা করা যাবে না, ভদ্রভাবে কথা আদায় করতে হবে। এদিকে ডিবিতে এমন কেউ নেই যে এ কাজটা ঠিকঠাকমতো করতে পারবে। তবে এক সময় ডিপার্টমেন্টে কর্মরত অবস্থায় কেএস খান কারোর পেট থেকে কথা আদায় করার বেলায় বেশ দক্ষ হিসেবেই পরিচিত ছিলো। সুতরাং ছফার এই চাওয়াটা একদিক থেকে ঠিকই আছে।
ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ নিজের ফ্ল্যাটের স্টাডিরুমে বসে থাকলেও একটু অস্বস্তিতে আছেন বলে মনে হলো। তার অভিজাত ভঙ্গিটি বেশ ভালোভাবেই ধাক্কা খেয়েছে। এক ধরণের উদ্বেগও দেখা যাচ্ছে ভদ্রলোকের মধ্যে। কেএসকের কাছে এটা খটকা বলেই মনে হলো। একজন অভিজ্ঞ সার্জন কেন এতো সহজে ঘাবড়ে যাবে? তার নার্ভ তো বেশ শক্ত হবার কথা।
জাওয়াদ নামের ছফার সহকারী ছেলেটা ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে আছে। সে অপেক্ষা করছে কেএস খানের পদ্ধতি দেখার জন্য। এই লোকের এতো সুনাম শুনেছে যে, রীতিমতো কিংবদন্তী চরিত্র বলে মনে করে তাকে। এখন কিংবদন্তীর কীর্তি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
আজ সকাল থেকে কেএস খানের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিলো। বিকেলের দিকে আবার বাজে সর্দির আগমন ঘটেছে। রুমালটা দিয়ে নাক মুছে নিলো সে। “সরি,” বিব্রত হয়ে বললো এক সময়কার ডিবির তুখোড় ইভেস্টিগেটর।
“ইটস ওকে,” ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ বললেন। “আপনার উচিত অ্যালার্জির ওষুধ খাওয়া, নইলে সর্দিটা বেশ ভোগাবে।”
রুমালটা পকেটে রেখে মুচকি হাসলো কেএস খান। “ওষুধ আমি সবই…কোনোটাই বাদ দেই না কিন্তু কম হয় না। আমি হইলাম ওষুধের ব্ল্যাকহোল…যেটাই খাই সব ভ্যানিশ হইয়া যায়।” তারপর হেহে করে হেসে ফেললো।
ডাক্তারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আর সবার মতো তিনিও মি. খানকে চলভাষায় কথা বলতে দেখে অবাক হয়েছেন। “আপনার কি ক্রনিকল ডিজিজ রয়েছে?” ডাক্তারের মতো আচরণ করার চেষ্টা করলেন। মি. সায়িদ।