মুশকান জুবেরি চেষ্টা করলো নির্বিকার থাকার কিন্তু ছফার দৃষ্টিতে সেটা এড়ালো না।
“এটা অবশ্যই খুনির কাজ। সে খুব সতর্ক। শিকারকে বাগে পেয়ে তাকে হত্যা করার আগেই যেভাবে হোক তার কাছ থেকে পাসওয়ার্ডটা নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু একজনের বেলায় সে এটা করতে পারে নি।”
মুশকান তারপরও চুপ রইলো।
“ঐ একজন হলো শেষেরজন। যার কেসটা আমি তদন্ত করছি। এরইমধ্যে পুলিশের একটা নতুন ডিপার্টমেন্ট হয়েছে…টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেল…ওরা খুবই আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে। আমি ওদের সাহায্য নিয়েছিলাম…অবশেষে ওরা হাসিবের অ্যাকাউন্টটার পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করতে পেরেছে। অ্যাকাউন্টটা চেক করে দেখা গেছে ওখানে চারুলতা নামের একটি আইডির সাথে হাসিবের নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো।”
মুশকান বাঁকাহাসি দেবার চেষ্টা করলেও সেটা কেমন মলিন দেখালো।
“চারুলতা আইডিটির লোকেশন ট্র্যাকডাউন করা হয়েছে..ওটা এখানকার…এই সুন্দরপুরের।”
“সুন্দরপুর হয়তো একটি মফশ্বল শহর কিন্তু বর্তমানে এখানে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে।”
“তা করে। তবে তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ক-জন আছে যে তার রেসটুরেন্ট নাম রাখবে উনার নামে? ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম দেবে উনার সষ্ট চরিত্রের নামে?” মাথা দুলিয়ে আরার বললো সে, “সম্ভবত খুব কম। আরতাদের মধ্যে নারী আছে ক-জন?”
ছফার দিকে তাকিয়ে হাসলো মিসেস জুবেরি। “তাহলে এখন আমাকে গ্রেফতার করছেন না কেন? আপনি খুবই নিশ্চিত। শক্ত প্রমাণও আছে আপনার কাছে।”
“হুম। তবে একটু অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই আমার সিনিয়র কলিগ মি, খান আপনার ঐ বন্ধু ডাক্তার আসকারের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করে আনতে পারবে।”
মুশকান চুপ থেকে নিজের ঘরের চারপাশটা দেখে নিলো একবার। “আপনি কি আমার সম্পর্কে সত্যিটা জানতে চান?”
ছফা বাঁকাহাসি দিলো। “আমি তো জানতাম সেটা জানার জন্যই এখানে এসেছি।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মুশকান। “আপনি যখন আমার সব সত্যি জানতে পারবেন তখন বুঝতে পারবেন কতোটা ভুল ধারণা করেছিলেন আমার সম্পর্কে। আপনার সবগুলো অনুমানই মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে যাবে। আপনার তখন মনে হবে আমার পেছনে লেগে খামোখাই সময় নষ্ট করেছেন। তদন্তকারী হিসেবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে ফেলেছেন?”
ভুরু তুললো ছফা। “বেশ। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সবটা শোনার জন্য।”
“আপনি অনেক কিছু জানলেও আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটার কথা জানেন না। ওরকম কঠিন পরিস্থিতিতে খুব কম মানুষই পড়েছে। আর তারচেয়েও অনেক কম মানুষ টিকে থেকে বেঁচে আসতে পেরেছে সভ্য দুনিয়ায়। আমিও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছিলাম কিন্তু ঘটনাটি আমাকে সারাজীবনের জন্য বদলে দিয়েছে।”
. “ঘটনাটা কি?” কৌতূহলী হয়ে উঠলো ছফা। সে এসব কথার মাথামুণডু কিছুই বুঝতে পারছে না।
উঠে দাঁড়ালো মিসেস জুবেরি। “আমি দশ বছর বয়সে আমেরিকায় চলে যাই বাবা-মায়ের সাথে…” সারি সারি বইয়ের শেলফের কাছে গিয়ে থামলো সে। “হাইস্কুল শেষে ওখানকার এক মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই…” একটা বড় আকৃতির চারকোণা অ্যালবাম বের করে আনলো বুকশেলফ থেকে। “…ফাইনাল ইয়ারের সামার ভ্যাকেশনে আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করি।” অ্যালবামটা নিয়ে এসে আগের জায়গায়। বসলো। “আমাদের গন্তব্য ছিলো লাতিন-আমেরিকা। মাচুপিচু..ইনকা সভ্যতা…মেক্সিকান পিরামিড…এসব দেখবো…” অ্যালবামটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো এবার। “..এটা দেখুন। ওই ভয়ঙ্কর কাহিনীটা বলতে ভালো লাগে না। দুঃসহস্মৃতি রোমন্থন করা আনন্দের কোনো বিষয় নয়।”
ছফা অ্যালবামটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো মুশকান জুবেরির দিকে।
“আপনি এটা দেখলেই সব বুঝতে পারবেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে অ্যালবামটা খুললো সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো। প্রথম পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে বোল্ড ফন্টে লেখা : অ্যালাইভ।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা ফাঁকা, তৃতীয় পৃষ্ঠায় চার-পাঁচটা পারিবারিক ছবি। একটি সুখি পরিবার। মা-বাবা, ভাই-বোন।
“আমার ফ্যামিলির ছবি…” আস্তে করে বললো মুশকান।
ছফা লক্ষ্য করলো ছবিতে কোনো সন-তারিখ দেয়া নেই। পোশাক আশাক দেখেও নিশ্চিত হতে পারলো না ছবিগুলো কোন দশকের। চতুর্থ পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে দেখলো পৃষ্ঠাগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে। বোঝা যাচ্ছে খুব একটা খুলে দেখা হয় না, একান্তই ব্যক্তিগত একটি অ্যালবাম। নিশ্চয় বাইরের খুব কম মানুষই এটা দেখেছে। হয়তো অনেকদিন কেউ ধরেও দেখে নি। চতুর্থ পৃষ্ঠায় যেতে ছফাকে রীতিমতো আঙুলে থুতু মেখে ওল্টাতে হলো। এই পৃষ্ঠায় আছে আরো ছয়-সাতটি ছবি। সবগুলোই স্কুলের। কিশোরি মুশকান আর তার সাদা-কালো-বাদামি বন্ধুরা। তাদের অঙ্গভঙ্গি খুব মজার। কেউ ভেংচি কাটছে তো কেউ চোখ ট্যারা করে আছে। কেউ বা মুখ ঢেকে রেখেছে।
“আমি স্কুল ভীষণ পছন্দ করতাম…বলতে গেলে স্কুলে যাবার জন্য মুখিয়ে থাকতাম প্রতিদিন।”
চকিতে মুশকান জুবেরির দিকে তাকালো ছফা। পঞ্চম পৃষ্ঠায় চোখ বুলালো সে। সম্ভবত কলেজের ছবি।
“স্কুলের মতোই কলেজও খুব ভালোবাসতাম। কলেজেই আমার সব বেস্ট ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় হয়।”