“তদন্ত করে এটাই পেলেন?” আবারো বাঁকাহাসি দেখা গেলো মুশকানের ঠোঁটে। “এটা পত্রপত্রিকায় তো ডিটেইল এসেছিলো।”
“কিন্তু যেটা ডিটেইল আসে নি সেটা হলো কে কে এর সাথে জড়িত ছিলো।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সাবেক ডাক্তার। “আজ এতোদিন পর আপনি কি সেটা উদঘাটন করতে পেরেছেন?”
“ঘুম,” মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বললো ছফা।
“আমি কিন্তু খুব আগ্রহ বোধ করছি এটা শোনার জন্য
“অরিয়েন্ট হাসপাতালের চার-পাঁচজন সার্জনকে সন্দেহ করা। হচ্ছিলো।”
“এটাও পত্রিকার খবর। ওরা আমাদের প্রায় সব সার্জনকেই সন্দেহ করে খবর ছাপিয়েছিলো। আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো ব্যাপার আর কি।”
“ওখানে কিন্তু আপনার নামও ছিলো?”
“অবশ্যই ছিলো। সেইসাথে আরো চারজনের নাম। কিনতু কেউ প্রমাণ করতে পারে নি আমরা এ-কাজে জড়িত ছিলাম। এ দেশের প্রায় সব প্রাইভেট হাসপাতাল এভাবেই অর্গ্যান কালেক্ট করে দালালদের মাধ্যমে। এর সঙ্গে ডাক্তাররা জড়িত থাকে না। একটু থেমে আবার বললো, “মনে রাখবেন, একটা অভিযোগ উঠেছিলো, আর সেটা কেউ প্রমাণ করতে পারে নি।”
“করার চেষ্টাই করে নি,” চট করে বলে উঠলো ছফা, “ঘটনাটা ওখানেই ধামাচাপা দেয়া হয়।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান জুবেরি। “এটা আপনার নিজস্ব মতামত…এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।”
কথাটা গায়ে না মেখেই বললো ছফা, “ওই ঘটনার পরই আপনি হ্রট করে একদিন চাকরি ছেড়ে দেন। সম্ভবত, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনাকে সেফ-এক্সিট করে দেবার জন্য চাকরি ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো, কারণ ওখানকার সবচাইতে প্রভাবশালী ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সাথে আপনার বেশ ভালো সম্পর্ক।”
“এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। আমরা অসম্ভব ভালো বন্ধু।”
ছফা গালে হাত বুলাতে লাগলো।
“তবে আমার চাকরি ছাড়ার সাথে উনার কিংবা ঐ ঘটনার কোনো সম্পর্কই নেই। ওটা ছিলো একেবারেই আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তাছাড়া আপনি হয়তো জানেন না, অর্গ্যান ডোনেটের কেলেঙ্কারির কয়েক মাস পর আমি চাকরি ছাড়ি। ততোদিনে ঐ ঘটনার কথা সবাই ভুলে গেছিলো।”
“আচ্ছা, তাহলে আমি কি জানতে পারি, চাকরিটা কেন ছেড়েছিলেন?”
“আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তারি করতে আর ভালো লাগছিলো না। নিত্য-নতুন রান্না করা, রেসিপি বানানো, ভিন্ন ভিন্ন কুইজিন নিয়ে এক্সপেরিয়েমেন্ট করা…এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। অবশ্য এরজন্য রাশেদ অনেকাংশে দায়ি। তাকে প্রতিদিন মজার মজার সব রেসিপি খাইয়ে মুগ্ধ করে দিতাম। আমার হাতের রান্না খেয়ে একজন মানুষ এমনভাবে তৃপ্ত হচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগতো। প্রচণ্ড উৎসাহি হয়ে পড়েছিলাম। টাকা পয়সার তেমন অভাব ছিলো না, সুতরাং চাকরিটা বোঝা মনে হতে লাগলো, তাই ছেড়ে দিলাম।”
ছফা নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো মুশকানের দিকে।
“আপনি আমাকে ঠিক কি নিয়ে সন্দেহ করছেন, স্পষ্ট করে বলবেন। কি?”
মিসেস জুবেরির প্রশ্নে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো সে।
“কিছু মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া..হাসপাতালের অর্গান কেলেংকারি…আমার চাকরি ছেড়ে দেয়া…এসব একসূত্রে গেঁথে আপনি আসলে কি প্রমাণ করতে চাইছেন?”
ছফা গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “আমি নিশ্চিত, আপনি ঐ নিখোঁজ মানুষগুলোর মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের সাথে জড়িত
মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগলো মুশকান, যেনো হাস্যকর কোনো জোক শুনেছে সে। “আমি অর্গ্যান পাচার করি?”
“হ্যাঁ,” বেশ জোর দিয়ে বললো ছফা।
“তারপর ওই মানুষগুলোকে মেরে গুম করে ফেলি, তাই না?”
ছফা কোনো জবাব দিলো না।
“এ কাজে নিশ্চয় ঐ কবর খোরার ছেলেটা..ফালুও জড়িত…কী বলেন?”
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। তার সামনে যে মহিলা বসে আছে। তার কথা আর ভাবভঙ্গি দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সবটা কেমনজনি প্রহেলিকাময় বলে মনে হচ্ছে।
“আমার চাকরি ছাড়ার সত্যি কারণটা জানতে চান?”
ছফা নিশচুপ রইলো।
“লিভার-কিডনির কেলেংকারির আগেই ডাক্তারি পেশার প্রতি মন উঠে গেছিলো। একটা কারণ তো আগেই বলেছি, আরেকটা কারণ হলো, এদেশের মানুষ ডাক্তারদের সম্মান করে না। কোনো রোগি মারা গেলেই তারা ডাক্তারকে দোষি মনে করে। তাদের ধারণা ডাক্তারের অবহেলাই রোগির মৃত্যুর একমাত্র কারণ। ডাক্তার যেনো মর্তের ঈশ্বর…সে চাইলেই যেকোনো রোগিকে বাঁচাতে পারে।” একটু থামলো মুশকান। “শুধু অভিযোগ, গালাগালি আর অসম্মান করলেও হয়তো সহ্য করে এই পেশায় থাকতাম কিন্তু তা তো হয় না। ডাক্তারকে রীতিমতো মারতে আসে। চোখের সামনে অনেক ডাক্তারকে মৃতরোগির বিক্ষুব্ধ আত্মীয়দের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। এই ভয়ে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকতাম। বিশেষ করে আমি সার্জন হওয়ায় প্রচুর। অপারেশন করতে হতো…রোগির মৃত্যু হতো অনেক ক্ষেত্রে…প্রতিটি অপারেশনের সময় তাই নার্ভাস হয়ে পড়তাম। অবশেষে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই চাকরিটা ছেড়ে দেই
সব শুনে ছফা মুচকি হাসলো। মুশকানের এই ব্যাখ্যাটা আমলে না। নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো সে। “আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম… যে পাঁচজন ভিক্টিম, আই মিন মিসিং-পারসনের কথা বলছি তারা সবাই অন্য অনেকের মতো ফেসবুক ব্যবহার করতো। মজার ব্যাপার কি জানেন? তারা নিখোঁজ হবার পর পরই অ্যাকাউন্টগুলো ডি-অ্যাক্টিভ হয়ে। গেছে সবার!”