গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো মিসেস জুবেরি, কিছু বলতে গিয়েও যেনো বললো না।
“হাসিবের মামা খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত আগ্রহে কেসটা আমাকে দেয়া হয়েছে। প্রথমে আমি তদন্ত করে কিছুই পাই নি। কেসটা একেবারে কানাগলির মতোই একটা জায়গায় গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। সেখান থেকে এক পা-ও এগোতে পারি নি। অবশেষে একটা সূত্র পেয়ে যাই। হাসিব যে ট্যাক্সিখ্যাবে করে এখানে এসছে সেটা ট্রেস করতে পারি। ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, হাসিব ঢাকা থেকে এখানে, আপনার ঐ রবীন্দ্রনাথে এসেছিলো। তারপর থেকে সে নিখোঁজ।”
“এর মানে কি?” মুশকান জুবেরিকে বিস্মিত দেখালো। “রবীন্দ্রনাথে প্রতিদিন শত শত লোক আসে..খাওয়া-দাওয়া করে আবার চলে যায়…তারা কোথায় যায়…কি করে…সেখান থেকে নিখোঁজ হয় নাকি গুম হয় তা আমি কিভাবে জানবো? এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “ঐ ড্রাইভার বলেছে, কাকতালীয়ভাবে সে হাসিবের ঘটনার দু-মাস আগে আরেকজনকে নিয়ে এখানে এসেছিলো।”
“বাহ্” বাঁকাহাসি দিলো মিসেস জুবেরি। “দু-জন লোক দু-তিনমাসের ব্যবধানে এখানে চলে এলো…তারপর তাদের আর খোঁজ পাওয়া গেলো না…এ থেকে আপনি কি করে আমাকে জড়ালেন? এখানে আমার কি ভূমিকা?”
ছফা বাঁকাহাসি দিলো, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হেনে চেয়ে থেকে বললো, “মিসেস জুবেরি, আমি কিন্তু বলি নি দ্বিতীয়জন নিখোঁজ হয়েছে। বলেছি, ঐ লোকটাও এখানে এসেছিলো।”
এই প্রথম মুশকান একটু ভড়কে গেলো, তবে সেটা খুবই সামান্য সময়ের জন্য, তারপর গভীর করে দম নিয়ে বললো, “আমি ভেবেছি আপনি দু-জন নিখোঁজ হবার কথা বলছেন।”
“যাহোক, শুধু দু-জন হলেও ব্যাপারটা কাকতালীয় বলে ধরে নিতাম,” আস্তে করে বললো ছফা। “কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে এরকম আরো তিনটি ঘটনা পেয়েছি…ওরা সবাই একদিন হ্রট করে নিখোঁজ হয়ে গেছে।”
অবিশ্বাসে তাকালো মুশকান জুবেরি। “ওরা সবাই এখানে এসে নিখোঁজ হয়েছে আর সেই কাজটার সাথে আমি জড়িত…এর কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
পাঁচজনের মধ্যে দু-জন ভিক্টিম যে এখানে এসেছিলো সেটা ঐ ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভারই সাক্ষী।”
“আর বাকিদের ব্যাপারটা?”
“ওটা আমার অনুমান।”
“শুধুই অনুমান? কোনো প্রমাণ নেই?”
ছফা হাসলো। আশা করছি সেটা খুব জলদিই পেয়ে যাবো। ঢাকায় আমার এক সিনিয়র কলিগ ওটা দেখছেন।” একটু থেমে আবার বললো সে, “অরিয়েন্ট হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদকে নিশ্চয় আপনি চেনেন?” মুশকানের জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বললো, “উনাকে আমার ঐ কলিগ জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।”
মুশকান জুবেরি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো, সেই চোখে কি খেলা করছে। তা অবশ্য বোঝা গেলো না। শুধু চোখের মণিগুলো মৃদু নড়ছে।
“আমার ঐ কলিগ কিন্তু খুব বিখ্যাত..জীবনে কোনো কেসে ব্যর্থ হন। নি…”।
“আর আপনি? আপনি কি কখনও ব্যর্থ হয়েছেন?”
মাথা দোলালো ছফা। “এখন পর্যন্ত হই নি। মনে হচ্ছে না খুব শীঘ্রই হবো।”
মুচকি হাসলো মিসেস জুবেরি। “মনে হচ্ছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আপনাকে উন্নাসিক বানিয়ে ফেলেছে। কিংবা ব্যর্থ হবার ভয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন!”
কথাটা আমলে না নিয়ে বললো নুরে ছফা, “অবশ্য আমার কলিগ আমার চেয়ে এককাঠি উপরে, আপনি হয়তো উনার নাম পত্রিকায়। দেখেছেন…ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খান।”
মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইলো মুশকান। নির্বিকার মুখেই বললো, “আমি পত্রিকা পড়ি না। ওগুলো পড়ার জিনিস বলে মনে করি না। অরুচিকর আর মুল জিনিস আমার ধাতে সয় না।” বাঁকাহাসি হেসে প্রসঙ্গে ফিরে এলো ছফা, “আমি নিশ্চিত, ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যতো শক্তিশালী নার্ভের অধিকারীই হয়ে থাকুন না কেন, মি. খানের সামনে টিকতে পারবেন না।”
মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালো মুশকান। “আমি ঐসব লোকজনকে নিয়ে কি করেছি বলে মনে করেন? মানে, আপনি বলছেন, পাঁচজন লোককে এখানে এনে উধাও করে দিয়েছি..তাদেরকে আমি কেন উধাও করবো? আপনার কি ধারণা, আমি তাদেরকে জবাই করে রবীন্দ্রনাথের রেসিপি বানিয়ে ভোজনরসিকদের প্লেটে তুলে দিয়েছি?” বাঁকাহাসি দিলো সাবেক ডাক্তার।
“না,” ছফাও পাল্টা হাসি দিয়ে বললো, “আমি অতোটা ফ্যান্টাসি করি নি এখনও।”
“ও,” কৃত্রিম অবাক হবার ভান করলে ডাক্তার মুশকান। “তাহলে কি ধারণা করেছেন, শুনি?”
“আপনি অনেক কথা বললেও একটা কথা এড়িয়ে গেছেন…” মুশকান জুবেরি অপেক্ষা করলো কথাটা শোনার জন্য।
“…অরিয়েন্ট হাসপাতালের ভালো চাকরিটা কেন ছেড়েছেন?”
“আপনার কি মনে হয়?”
“আমি জানতে পেরেছি, আপনি যখন চাকরিটা ছাড়েন তার আগে অরিয়েন্ট হাসপাতালে একটা কেলেংকারি ঘটে গেছিলো। পত্রপত্রিকায়ও সেটা এসেছিলো। খুবই বাজে ঘটনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও ধামাচাপা দিতে পারে নি।”
নীচের ঠোঁট দুটো কামড়ে চেয়ে রইলো মুশকান।
“গরীব মানুষকে অল্প টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে লিভার-কিডনি বিক্রি করাতেন আপনারা…মানে অরিয়েন্ট হাসপাতালের কিছু ডাক্তার আর কর্মচারি। সেইসব লিভার-কিডনি ধনী ক্লায়েন্টদের বাঁচাতে ট্রান্সপ্রান্ট করতে আপনার হাসপাতাল। এক সাংবাদিক এটার পেছনে লাগলে সবটা ফাঁস হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ দারুণ বিপাকে পড়ে।”