“আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?” শহুরে কাস্টমার ভদ্রভাবে বললো তাকে।
“কন, কি কইবেন।”
“কোথাও গিয়ে একটু বসি?”
অবাক হলো ইনফর্মার। তবে এরকম ঘটনা তার জন্য একেবারে বিরল নয়। মাঝে-মধ্যেই অচেনা লোকজন তার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চায়, কিছু ইনফর্মেশন জানতে চায়। অনেকে আবার নিষিদ্ধ জিনিসপত্রের খোঁজও করে। “চলেন, ঐ টঙ দোকানেই যাই,” রহমান মিয়ার দোকানটা দেখিয়ে বললো সে।
“ওখানে না, অন্য কোথাও।”
শহুরে কাস্টমারের দিকে ভালো করে তাকালো আতর। এই লোকটা কে হতে পারে? কি চায়? লোকাল থানার ইনফর্মার সে, কাউকে ভয় করে না। তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো।
“তাইলে চলেন, পেট্রলপাম্পের লগে একটা বটগাছ আছে…ঐটার নীচে বইসা কথা কওয়া যাইবো। রহমান মিয়ার টঙে বইসা কথা কইলে বেবাকৃতে জাইন্যা যায়। বুইড়ার আবার যার-তার লগে প্যাচাল পাড়নের স্বভাব।”
আতর এগিয়ে গেলো রবীন্দ্রনাথের বামপাশে বিশাল পেট্রলপাম্পের দিকে, তাকে অনুসরণ করলো শহরের লোকটি। পাম্পের ঠিক বিশ-ত্রিশ গজ দূরে একটি বিশাল বটগাছ, সেটার চারপাশ গোল করে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটি চত্বর।
“বসেন,” শানবাঁধানো বটের নীচে বসে বললো আতর আলী।
শহূরে লোকটি সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে বসে পড়লো।
“কন, কি কইবেন?”
ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করলে আতরের চোখে সেটা এড়ালো না। “উমম…ঐ রেস্টুরেন্টের মালিক সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছি…আমার ধারণা আপনার চেয়ে বেশি এ-ব্যাপারে কেউ খবর রাখে না।”
ভুরু কুচকে ফেললো সে। প্রশংসা তাকে বিগলিত করতে পারলো না। “আপনে কে, ভাই?”
চুপ মেরে রইলোশহুরে লোকটি।
“সাম্বাদিক?” আন্দাজ করে বললো ইনফর্মার।
স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ভদ্রলোক, যেনো অনিচ্ছায় স্বীকার করতে হচ্ছে পরিচয়টা।
“আমি আগেই বুঝবার পারছিলাম,” তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। আতরের মুখে। টিভির না পেপারের?”
“উমমম…পেপারের।”
“কুন পেপারের?”
“মহাকাল।”
আতরের চোখেমুখে সশ্রম ফুটে উঠলো এবার। “আচ্ছা…” একটু ভেবে বললো, “ঐ বেটির খবর জানবার চান?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো শহূরে লোকটি।
“আপনের নাম কি?”
“নুরে ছফা।”
“কি!” নামটা ধরতে পারলো না ইনফর্মার।
“নুরে ছফা,” একটু ধীরে আর জোরে বললো এবার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে একাধিকবার নিজের মান্ধাতা আমলের নামটা উচ্চারণ করতে হয়।
“ও।” আতরের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কখনও এমন অদ্ভুত নাম শোনে নি। “ঐ বেটির খবর দিয়া কি করবেন?”
নুরে ছফা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। “উনার হোটেল আর উনাকে নিয়ে একটা রিপোর্টিং করবো আমি কিন্তু ঐ মহিলা সম্পর্কে এই এলাকার লোকজন তেমন কিছুই জানে না। উনার হোটেলের লোকজন তো মুখই খোলে না কোনো ব্যাপারে। খুবই সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছি।”
বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর। এই সাংবাদিক কেন ঐ হোটেলের খাবার পছন্দ না করলেও খেতে গেছিলো সেটা বুঝতে পারলো। “ওই হোটেলে যারা কাম করে তারা কেউই এই এলাকার না..জানবো। কেমনে, কন? সব বাইরের ডিসটিকের লোক।”
“কিন্তু এই এলাকায় যারা থাকে তারাও তো তেমন কিছু জানে না?”
“ঐ বেটি এইখানকার মানুষ না। কয়েক বছর আগে আইছে। সুন্দরপুরে। ওর হিস্টোরি মাইনুষে কেমনে জানবো?”
“তাহলে আপনিও কি খুব বেশি জানেন না?”
আতর একটু থতমত খেলো। “আরে কি কন, আমি জানুম না ক্যান?”
ছফা অপেক্ষা করলো, আরো কিছু শুনতে চায় সে।
“বেটির অনেক পাওয়ার, বুঝলেন? ডিসি, এসপি, ইউনও-টিএনও সবুতে হের পিছে পিছে ঘুরে। আর এমপিসাব তো হের ভাইরা হইয়া গেছে।”
“কেন?”
“ক্যান আবার…বেটি সবতেরে জাদু করছে!” কথাটা আতর এমনভাবে বললো যেনো সে এ-ব্যাপারে একদম নিশ্চিত, সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।
“জাদু?”
“হুম।” বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনফর্মার। “আমার তো মনে হয় এই বেটি মানুষই না..ডাইনি!”
“ডাইনি?”
“কইথেকা যে উইড়া আইছে, আল্লা-ই জানে।”
“উনি কোত্থেকে এসেছেন আপনারা কেউ জানেন না?” নুরে ছফাকে বিস্মিত দেখালো।
ঢোক গিললো আতর। “এইখানে আইছেন…কয়দিন থাকেন, সব জানবার পারবেন।”
“ঐ মহিলাকে ডাইনি বললেন কেন? উনি করেছেনটা কি?”
“বেটি জাদুটোনা কইরা এমন খাওন বানায় যে আপনে মুখে দিছেন তো শ্যাষ…বুঝলেন?”
“শেষ মানে?” চোখেমুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললেও ছফা আসলে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইছে।
“মাইনে, আপনে হের চক্করে পইড়া গেলেন। বার বার হের খাওন। খাইতে আইবেন…আপনেরে আইতেই হইবো।”
“ও,” নুরে ছফা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। “আমি ভেবেছিলাম মারাত্মক কিছুর কথা বলছেন। মানে, তার খাবার খেয়ে ক্ষতি-টতি হয়,” মুচকি হাসলো সে। “ভালো খাবারের জন্য মানুষ বার বার ছুটে আসতেই পারে..তাতে তো কোনো সমস্যা দেখছি না?”
“কি কন,” হতাশ দেখালো আতর আলীকে। “জাদুটোনা কইরা যে। খাওন বানায় সেই খাওন সমস্যা না?”
“আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না…যদি না খাবারের মধ্যে অন্য কিছু থাকে।”
“এই যে, অ্যাতোক্ষণে লাইনে আইছেন,” হেসে উঠলো ইনফর্মার। দু পা তুলে বসলো এবার। “খাওনের মইদ্যে যদি উল্টাপাল্টা কিছু না-ই মিশায় মানুষ ক্যান হিরোইনচি’র মতো নেশাখোর হইবো, কন?”
“উল্টাপাল্টা কিছু মেশায়?” আৎকে উঠলো নুরে ছফা। তার মনে পড়ে গেলো আজ সে ওখানে পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া করেছে।